হোসেনউদ্দীন হোসেন: জীবন ও সাহিত্য

হোসেনউদ্দীন হোসেন এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
হোসেনউদ্দীন হোসেন: জীবন ও সাহিত্য

জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি
হোসেনউদ্দীন হোসেন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত যশোর জেলার ঝিকরগাছা থানার কৃষ্ণনগর গ্রামে। তাঁর জন্ম এক বনেদি কৃষক পরিবারে। তাঁর পিতা মরহুম কলিম উদ্দীন এবং মাতা মরহুম আরিছন নেছা। ১৯৬৩ সালে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন লাউজনি লক্ষ্মীপুর গ্রামের হাসিনা আক্তারের সঙ্গে। এই দম্পতির ঘরে জন্ম নেন দুই পুত্র ও দুই কন্যা।

স্ত্রী হাসিনা আক্তারের সাথে হোসেনউদ্দীন হোসেন
স্ত্রী হাসিনা আক্তারের সাথে হোসেনউদ্দীন হোসেন

শিক্ষাজীবনের প্রেক্ষাপট
প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কৃষ্ণনগর গ্রামের পল্লীমঙ্গল সমিতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর মাধ্যমিক স্তরে তিনি ঝিকরগাছা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং দশম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানে অধ্যয়ন করেন। এরপর ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা বোর্ডের অধীনে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন। ১৯৫৯ সালে একইভাবে আইএ পাশ করেন। যদিও তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এ পর্যায়েই শেষ হয়, কিন্তু স্বশিক্ষার মাধ্যমে তিনি সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন ও সমাজতত্ত্বে গভীরভাবে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। প্রচলিত পাঠ্যক্রমিক শিক্ষার গণ্ডি তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে প্রতিবন্ধক মনে হওয়ায়, তিনি নিজস্ব ধ্যান-ধারণায় আত্মনিবেদিত হন।

সাহিত্যিক জীবন ও প্রকাশনা
শৈশবকাল থেকেই তাঁর মধ্যে সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ গড়ে ওঠে। তিনি তখন থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়েই একটি হাতে লেখা পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ১৯৫৫ সালে কলকাতার ‘দৈনিক লোকসেবক’ পত্রিকার ছোটদের বিভাগে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে কোলকাতা ও ঢাকার বহু পত্রিকা ও সাময়িকীতে তাঁর কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ নিয়মিত ছাপা হতে থাকে। তাঁর লেখালেখির ক্ষেত্র ছিল বিস্তৃত — ছোটদের পত্রিকা থেকে শুরু করে জাতীয় দৈনিক, সাহিত্যপত্রিকা থেকে ছোটকাগজ—সবখানে তিনি সক্রিয় ছিলেন।

প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের তালিকা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। উপন্যাস, ইতিহাস, কিংবদন্তী, প্রবন্ধ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতিচারণ, শিশুতোষ গল্প থেকে শুরু করে সাহিত্যতত্ত্ব — তাঁর লেখনী পৌঁছে গেছে প্রায় প্রতিটি শাখায়।

যশোরাদ্য দেশ - হোসেনউদ্দীন হোসেন
১৯৭৪ সালে প্রকাশিত 'যশোরাদ্য দেশ' বইটির প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ


হোসেনউদ্দীন হোসেন-এর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ:
গ্রন্থের নামধরণপ্রকাশকাল
উনাশির শ্রেষ্ঠগল্পসম্পাদিত গল্প সংকলন১৯৭৯
নষ্ট মানুষউপন্যাস১৯৭৪
যশোরাদ্য দেশইতিহাস/প্রবন্ধ১৯৭৪
যশোর জেলার কিংবদন্তী (১ম খণ্ড)কিংবদন্তী১৯৭৪
অমৃত বৈদেশিকপ্রবন্ধ/অনুবাদ১৯৭৫
যশোর জেলার কিংবদন্তী (২য় খণ্ড)কিংবদন্তী১৯৭৯
প্লাবন এবং একজন নূহউপন্যাস১৯৭৯
ভলতেয়ার ফ্লবেয়ার তলস্তয় ত্রয়ী উপন্যাস যুগমানসসাহিত্য-সমালোচনা১৯৮৮
ঐতিহ্য আধুনিকতা আহসান হাবীবপ্রবন্ধ১৯৯৪
সাধুহাটির লোকজনউপন্যাস২০০১
বাংলার বিদ্রোহ (১ম খণ্ড)ইতিহাস২০০৩
শিমুল পলাশ সম্মাননা পদক (কলকাতা)পুরস্কার/উল্লেখ২০০৩
FLOOD AND A NOOHউপন্যাস (ইংরেজি)২০০৫
বাংলার বিদ্রোহ (২য় খণ্ড)ইতিহাস২০০৬
ইঁদুর মানুষেরাউপন্যাস২০০৮
সমাজ সাহিত্য দর্শনপ্রবন্ধ২০১০
সোনালী জলের কাঁকড়াউপন্যাস২০১১
রণক্ষেত্রে সারাবেলামুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি২০১২
লোকলোকোত্তর গাঁথাকিংবদন্তী২০১২
বনভূমি অন্যান্য গল্পগল্পগ্রন্থ২০১৩
অনন্য রবীন্দ্রনাথপ্রবন্ধ/সমালোচনা২০১৪
মন মানসের চালচিত্র, কবি কবিতাপ্রবন্ধ/সমালোচনা২০১৫
শেষ বিদায়ের আগেকবিতা২০১৫
কালান্তরের রূপকথাউপন্যাস২০১৮
উত্তরপুরুষগল্পগ্রন্থ২০২২
বাঙলার সংস্কৃতি লোজজীবনপ্রবন্ধ/সংস্কৃতি২০২৩
জগজ্জীবনউপন্যাস২০২৪

তিনি দীর্ঘদিন যাবত সাহিত্যপত্রিকা 'মরাল'-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, যা ২০০৮ সাল থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতো।

পেশাগত জীবন
হোসেনউদ্দীন হোসেন ষাটের দশকে সাংবাদিকতা পেশা বেছে নেন এবং স্বল্পকাল 'দৈনিক সংবাদ'-এ কর্মরত ছিলেন। তবে তাঁর মনে সাহিত্যচর্চাই ছিল প্রাধান্যপ্রাপ্ত। এক বছর পর সাংবাদিকতা ছেড়ে তিনি সম্পূর্ণরূপে সাহিত্যসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৬৮ সালে যশোর থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক 'নতুন দেশ' পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ পত্রিকাটি ১৯৭১ সালের ২০ মার্চ পর্যন্ত নিয়মিত প্রকাশিত হয়। যুদ্ধের পর তিনি পূর্ণ উদ্যমে কৃষিকাজে মনোনিবেশ করেন। আজীবন তিনি নিজেকে একজন কৃষক হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন।

নিজ চাষের ভুট্টাক্ষেতে পরিবার–স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে হোসেনউদ্দীন হোসেন।
নিজ চাষের ভুট্টাক্ষেতে পরিবার–স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে হোসেনউদ্দীন হোসেন।

যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও বীরত্ব
হোসেনউদ্দীন হোসেন একজন দেশপ্রেমিক যোদ্ধাও। ১৯৬৫ সালে হিন্দুস্থান-পাকিস্তান যুদ্ধকালে তিনি স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনীতে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে অংশ নেন এবং ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। ১৯৬৭ সালে স্বেচ্ছায় সেনা জীবন থেকে সরে এসে সাধারণ জীবনযাপন শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং বহু গুরুত্বপূর্ণ ও সফল অভিযান পরিচালনা করেন।

সাহিত্য পুরস্কার ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
তাঁর সাহিত্যকর্ম ও সমাজসেবার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
সম্মাননা / পদকের নামসাল
চাঁদের হাট পদক১৯৯০
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্মৃতি পদক১৯৯৬
বিজয় দিবস পদক১৯৯৭
মাইকেল মধুসূদন একাডেমী পদক২০০১
শিমুল পলাশ সম্মাননা পদক২০০৩
লিটল ম্যাগাজিন সম্মাননা পদক২০০৩
কোলকাতা বিধান নগর (সল্টলেক) মেলা পদক২০০৪
কণ্ঠশীলন সম্মাননা পদক২০০৬
গুণীজন সম্মাননা পদক২০০৬
এম, এল হাই স্কুল সম্মাননা পদক২০০৬
ক্যাম্ব্রিজ স্বর্ণপদক২০০৬
কপোতাক্ষ সম্মাননা পদক২০০৭
আয়েসা জব্বার সম্মাননা পদক২০০৭
বইমেলা সম্মাননা পদক (মনিরামপুর)২০০৮
বিবর্তন আজীবন সম্মাননা পদক২০১০
বইমেলা সম্মাননা পদক (যশোর ইনস্টিটিউট)২০১০
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক সম্মাননা পদক২০১০
সিকানদার আবু জাফর পদক২০১৬
সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার২০১৬
ঐতিহ্য পদক২০২০
বাংলা একাডেমি পুরষ্কার
গুণিজন সম্মাননা (দৈনিক কল্যাণ)
২০২১
২০২২


২০০৬ সালের ৬ই জুন ইংল্যান্ডের ক্যাম্ব্রিজে Top 100 Writers স্বর্ণপদক দিয়ে হোসেনউদ্দীন হোসেনকে সম্মানিত করছেন আইবিসি-র ডাইরেক্টর জেনারেল মিঃ নিকোলাস এস. ল। পাশে দাঁড়ানো হোসেনউদ্দীন হোসেন-এর সহধর্মিনী হাসিনা আকতার।
২০০৬ সালের ৬ই জুন ইংল্যান্ডের ক্যাম্ব্রিজে Top 100 Writers স্বর্ণপদক দিয়ে হোসেনউদ্দীন হোসেনকে সম্মানিত করছেন আইবিসি-র ডাইরেক্টর জেনারেল মিঃ নিকোলাস এস. ল। পাশে দাঁড়ানো হোসেনউদ্দীন হোসেন-এর সহধর্মিনী হাসিনা আকতার।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ২০০৬ সালে তাঁকে ইংল্যান্ডের ক্যাম্ব্রিজ থেকে বিশ্বের Top-100 লেখকের একজন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তাঁর লেখা উপন্যাস 'ইঁদুর ও মানুষেরা' ২০১০ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে এম.এ. পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়।

বাংলা একাডেমি পুরষ্কার গ্রহণকালে হোসেনউদ্দীন হোসেন। সাল ২০২২।
বাংলা একাডেমি পুরষ্কার গ্রহণকালে হোসেনউদ্দীন হোসেন। সাল ২০২২।

মহাপ্রয়াণ
হোসেনউদ্দীন হোসেন ২০২৪ সালের ২০ মে, সোমবার বিকেল ৪টা মিনিটে যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট, কিডনি জটিলতা এবং ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছিলেন। ২০১৯ সালে তাঁর ওপেন হার্ট সার্জারি হয় এবং পরবর্তীতে গলব্লাডারে পাথর ধরা পড়ে। ১৪ মে ২০২৪ তারিখে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার আরও অবনতি হলে তাঁকে সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে ২০ মে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন

হোসেনউদ্দীন হোসেন বাংলা সাহিত্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ ও বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব। তিনি শুধু একজন ঔপন্যাসিক বা কবিই নন, একজন সমাজবিজ্ঞানী, মুক্তিযোদ্ধা, ইতিহাসসন্ধানী গবেষক ও সাহিত্যের সত্যিকারের সাধক। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে গভীরভাবে ভালোবেসে তিনি আজীবন লড়ে গেছেন কলমের শক্তিতে, এবং রেখে গেছেন মূল্যবান সাহিত্যভাণ্ডার, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে।

Keywords:

  • হোসেনউদ্দীন হোসেন
  • হোসেনউদ্দীন হোসেন জীবনী
  • হোসেনউদ্দীন হোসেন সাহিত্যকর্ম
  • হোসেনউদ্দীন হোসেন মুক্তিযোদ্ধা
  • বাংলা সাহিত্য

1 মন্তব্যসমূহ

নবীনতর পূর্বতন

আরো পড়ূন

ঝিকরগাছা উপজেলা : ইতিহাস, ঐতিহ্য, তত্ত্ব ও তথ্য

ট্যাগ সমূহ

ঝিকরগাছার ইতিহাস, ঝিকরগাছা উপজেলার ইউনিয়ন, ঝিকরগাছা খবর, গদখালি ঝিকরগাছা, ঝিকরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান, ঝিকরগাছা পোস্ট কোড, ঝিকরগাছা এমপি, ঝিকরগাছা আবহাওয়া, ঝিকরগাছা উপজেলা ম্যাপ, ঝিকগাছার ঐতিহ্য, পানিসারা, ঝিকরগাছা পৌরসভা, ঝিকরগাছা দর্শনীয় স্থান, ঝিকরগাছা বাজার।