স্টিমার, কপোতাক্ষ ও কলকাতা: মনোজ বসুর স্মৃতিতে ঝিকরগাছা

বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য রূপকার মনোজ বসু। তাঁর রচনার সহজাত সারল্য গ্রামীণ জীবনের প্রাণস্পন্দনকে ধারণ করে। ‘পথচলি’ তাঁর আত্মজৈবনিক আখ্যান। গ্রন্থটির একটি অংশে লেখকের প্রথম কলকাতা যাত্রার স্মৃতি বিবৃত হয়েছে, যার পথরেখা বিস্তৃত ঝিকরগাছা ঘাট হয়ে কপোতাক্ষ নদের জলপথে। এক বালকের চোখে দেখা সেই দীর্ঘ জলযাত্রা কেবল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, বরং সেই সময়ের যাতায়াত ব্যবস্থা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার এক মূল্যবান চিত্রায়ণ।

কপোতাক্ষ তখন কেবল কবির কাব্যে নয়, দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার দৈনন্দিন জীবনের ধমনি ছিল। এই নদীপথ ধরেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ স্টিমার বা লঞ্চে কলকাতায় যাতায়াত করত। সেই পথের কাহিনি, নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলী, বিলাতি স্টিমার কোম্পানির প্রভাব এবং দেশীয় স্টিমার সার্ভিসের সঙ্গে তার প্রতিযোগিতা—এইসব মিলিয়ে তৈরি হয় এক ঐতিহাসিক পটভূমি, যা আজ অতীত।

ঝিকরগাছার ঘাট, পথের স্মৃতি এবং কপোতাক্ষের স্রোত এই লেখায় বারবার ফিরে আসে, যা আমাদের আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে যেন এক দিগ্দর্শন। ঝিকরগাছা জনপদ ও কপোতাক্ষ অববাহিকায় আগ্রহী পাঠকদের জন্য, গ্রন্থটির এই অংশটি jhikargacha.com-এ প্রকাশ করা হলো। —সম্পাদক


কলকাতা যাচ্ছি। প্রথম সেই কলকাতা দেখা। রেলগাড়ি দেখা এবং রেলে চড়াও হয়ে যাচ্ছে এই মওকায়। মাদার বক্সর ঘোড়ার গাড়িতে যশোর অবধি ভাড়া এক টাকা। এটা হল সাধারণ দর। পালে-পার্বণে দেড়া কখনও বা দুনো হয়ে যায়। পথ তো সাকুল্যে কুড়ি মাইল-কোম্পানির মাপজোপের মাইল, লোহার খোঁটায় নিশানা দেওয়া, দশ পা যেতে না যেতেই মাইল পুরে যায়। এমনি বিশ নম্বরের খোঁটায় পৌঁছবার মাশুল ষোল আনা। টাকা-পয়সা যেন খোলামকুচি ভেবেছে, বলুন না! গায়ে তাগত থাকলে কে যাবে অত দরের ঘোড়ার গাড়ি চড়তে? হেঁটেই মেরে দেবে পথটুকু।

মুশকিল হয়েছে, আমি বাচ্চা একেবারে। সেজ-দা বুদ্ধি বাতলালেন, স্টিমারে যাই না কেন? ঝাঁপা থেকে ঝিকরগাছা ঘাট। ঝিকরগাছায় রেলস্টেশন। স্টিমারে নেবে তিন আনা। এক আনা ভাড়ারও আছে, তাতে ভাল লোক যায় না। 

ঝাঁপা এক বেলার হাঁটাপথ। সুবিধা আছে, পিশিমার বাড়ি কাছাকাছি-সেখানে উঠে পুরো দিন জিরিয়ে নেবো। রাত থাকতে বেরুলাম সেজ-দা আর আমি। বাঁশের সাঁকোয় হরিহর পার হলাম। বাজিকর দড়ির উপরে হাঁটে দেখেছেন? সেই ব্যাপার। দুটো করে বাঁশ ফেলা আছে এপার-ওপার। হাতে ধরবারও ছিল বোধ হয়। সে বাঁশ খুলে পড়ে গাঙের জলে ভেসে গেছে, অথবা খুলে নিয়ে কেউ উনুনে পুড়িয়েছে। অতএব নিচের বাঁশ দু-খানার উপর হিসাব করে করে পা ফেলে পার হবেন। পার হয়েও গেলাম, জলে পড়িনি। পাকা রাস্তা-একটু সেখানে পা ছুঁইয়েই ওদিককার মাঠে নেমে পড়ি। মাঠ, মাঠ -অড়হর-ক্ষেত, লঙ্কা-ক্ষেত। ভূঁইকুমড়ো বেগুন ও শশার ক্ষেত। এক একটা গ্রাম-হাঁসাডাঙা, শ্যামকুড়, রতিন্দে-মাঠের মাঝে মাঝে দ্বীপের মতন। কচি শশা ছিঁড়ে নিয়ে চিবোচ্ছি। চিবোতে চিবোতে জল তেষ্টা পেয়ে যায়। চল্, আর দু-খানা গ্রামের পর নেংড়ের হাটখোলা। ময়রার দোকান আছে। শুধু জল কেন, মুড়ি-বাতাসা খেয়ে জল খাবি পেটে ভর থাকবে। মনে হল, এক যুগ ধরে হাঁটছি। সে নেংড়ের হাটখোলা আসে না আর কিছুতে।

ঝিকরগাছা ঘাটে বাঁধা ছইওয়ালা নৌকা। সাল ১৯৭১।
ঝিকরগাছা ঘাটে বাঁধা ছইওয়ালা নৌকা। সাল ১৯৭১।

তেপান্তরের মাঠের শেষে ক-খানা টিনের চালা। হাটখোলা পেয়ে গেছি অবশেষে। টিনের চালে রোদ পড়ে ঝলমল করছে। মুড়ি-বাতাস। থাক, এক ফেরো জল খেয়ে বাঁচি তো আগে। জল খেয়ে বাঁশের বেঞ্চির উপর খুঁটি ঠেশান দিয়ে জিরোচ্ছি। আবার মাঠে নামতে মন চায় না। আর কি, এসে তো গেলাম রে! ওই যে তালগাছ ঐখানে পিশিমার বাড়ি। ওঠ। 

মিছে কথা। কত তালগাছ ছাড়িয়ে চললাম। পিশিমার বাড়ি আসে না। হঠাৎ সেজ-দা আঙুল দেখালেনঃ ঐ দেখ পিশিমা। বাঁওড়ে চান করতে চললেন বুঝি? ডাক দে। 
মাঝবয়সি বিধবা একজন। সত্যি বুঝি পিশিমা! উহু, পিশিমা এমন নোংরা ছেঁড়া কাপড়ে থাকবেন কেন? এমনি নানান হাসি-গল্পে সেজ-দা পথের কষ্ট বুঝতে দিচ্ছেন না। 

ভোঁ-ও-ও করে আওয়াজ দিল কোন দিকে। স্টিমারের সিটি। এসে পড়েছি অতএব কাছাকাছি, আর দেরি নেই। সেজ-দা বলেন, স্টিমার কপিলমুনি চলল ঝিকরগাছা থেকে। কাল ফিরবে, কালকে যাব আমরা। 
ঘণ্টা তিন-চার কেটেছে তারপরে। আঁচাতে যাচ্ছি, আবার স্টিমারের সিটি। বেশ আলাদা। খাওয়া-দাওয়া সেরে এবারের আওয়াজটা 
- এ কোথাকার স্টিমার সেজ-দা? 
- এ হল কুণ্ডলা। ঝিকরগাছা চলল, রাতের ট্রেন ধরিয়ে দেবে। 
- তবে তো এটাতেই আজ যাওয়া যেত। 
ছেলেমানুষের নির্বুদ্ধিতার পিশিমা হেসে উঠলেন: দূর, কুণ্ডলা স্টিমারে ভাল লোক যায় কখনও! 
পরে দেখেছি এই কুণ্ডলা স্টিমার। চড়েছিও। প্যাসেঞ্জারের আরামের যত ব্যবস্থা সেই আমলে সম্ভব, সমস্ত ছিল। কিন্তু ভদ্রসজ্জন কেউ চড়বে না, যেহেতু বিলাতি হোরমিলার কোম্পানি ঐ স্টিমার লাইনে এনেছে। কমাতে কমাতে ভাড়া এক আনা করেছে ঝিকরগাছা অবধি। তবুনা। শোনা গেল, প্যাসেঞ্জার একেবার মাংনা নেবে এর পরে। কিছুতেই কিছু হল না, শেষ পর্যন্ত ঐ কুণ্ডলা স্বদেশি কোম্পানিকে বেচে দিয়ে সরে পড়তে হয়েছিল লাইন থেকে। স্বদেশি কোম্পানির মাথায় পি. সি. রায় মশায়। অতি-ছোট্ট একটা স্টিমার চলে তাঁদের-স্টিমার না বলে স্ট্রিম-লঞ্চ বলা উচিত। মাদুর পেতে বসতে হয়। বিলাতি কোম্পানি ঘাটে-ঘাটে প্ল্যাটফরম বানিয়েছে, স্বদেশি স্টিমার সেখানে ধরতে দেয় না। নৌকো আছে স্বদেশি স্টিমারের গায়ে বাঁধা-আঘাটায় দাঁড়িয়ে মানুষে হাত উচু করলেই নৌকো গিয়ে তুলে নিয়ে আসে। ঝিকরগাছার ভাড়া তিন আনা অর্থাৎ কুণ্ডলার তিনগুণ। 

তা সত্ত্বেও এরা জায়গা দিতে পারে না, মানুষজন গিজগিজ করে। ভিড়ের চোটে একবার ডুবে গিয়েছিল এদের এই ছোট স্ট্রিমার। কুমির ভেসেছিল নদীতে, কুমির দেখতে মানুষ একদিকে ঝুঁকল, স্টিমার কাত হয়ে জল উঠে গেল। এদিকে এই কাণ্ড-আর বিলাতি স্টিমার, দেখুন গে, খা-খা করছে। সস্তা ভাড়ার লোভে দু-পাঁচজন যারা যায়, উপরের ডেকে ওঠে না তারা পারতপক্ষে; নিচের তলায় লুকিয়ে বসে থাকে। ঘাটে নেমেই কোন দিকে না তাকিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায়।

প্রথম আমার সেই স্টিমার চড়া। মাঝনদীতে স্টিমার, রেলিং ধরে অগণ্য মানুষ দাঁড়িয়ে-সাঁ-সাঁ করে নৌকো বেয়ে এসে ডাঙা থেকে আমাদের তুলে নিল। স্টিমারে চেয়ার-বেঞ্চির হাঙ্গামা নেই, মাদুর-সতরঞ্চি বিছিয়ে প্যাসেঞ্জাররা বসেছেন। সেজ-দাকে ডাকাডাকি করে, আসুন, এই যে-এদিকে। তাস চলবে তো? তাস, দাবা, পাশা, গানবাজনা-হরেক মজা চলছে। জমজমাট আড্ডা। আমাকেও বলে, বসে পড়ো না খোকা। 

খোকার বয়ে গেছে। কত কি বিস্ময়! কলঘরে ঘটাং-ঘটাং বোঁ-বো-কোন যন্ত্র ঘুরপাক খাচ্ছে, কোনটা মাথা নাড়ছে অবিরত এদিকে-ওদিকে। যত পাগলের কাণ্ডকারখানা। বয়লারের ঢাকনি খুলল-প্রলয়ের আগুন ওর ভিতরে, আগুনের আভায় কালো মানুষগুলো রাঙা রাঙা দেখাচ্ছে। পিছন দিকে প্রকাণ্ড চাকা বিষম জোরে জল কাটছে, জলের গুঁড়ি ফুরফুরিয়ে গায়ের উপর পড়ে। খাসা লাগে। দু-পাশে মাঠ-গ্রাম-বাঁশতলার ঘাটে ছেলেরা জল দাপাদাপি করছে, কলসি ভরছে মেয়েরা, স্টিমার দেখে হাঁ হয়ে থাকে। কেমন সুন্দর খড়ে ছেয়েছে গাঙের ধারের ঘর ক'খানা-এমনি জায়গায় আমাদের বাড়ি হলে রোজ রোজ স্টিমার দেখতাম। ধান কাটছে চাষীরা হাঁটুভর জলে দাঁড়িয়ে। ভোঁ-ও-ও-কোন ঘাট এটা গো? বাঁকড়া-বাঁক ঘুরে ঘুরে আসছে সেই জন্মে নাকি? এ কোন জায়গা? বল্লা। বেলা পড়ে আসে। সাদিপুর পার হলাম। হাটুরে মানুষ যাচ্ছে নদীর ধার দিয়ে-কাঁধে বাঁক, হাতে ঝোলানো হেরিকেন। হা-ডু-ডু খেলছে ছেলেরা মাঠের উপর। কোন ঘাট এবারে? রামগঞ্জ-এর পরেই ঝিকরগাছা। এসে গেলাম আর কি! লাল রঙের রেলের পুল দেখা যায়, গুম-গুম করে মালগাড়ি যাচ্ছে পুলের উপর দিয়ে। লাল পুল ছাড়িয়ে ওদিকে মানুষ চলাচলের আলাদা পুল-সেকালে কালী পোদ্দার মশায় মায়ের গঙ্গাস্নানের জন্য চাকদা অবধি পথ বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন, এই পুল সেই সময় বানানো। পৌষ-সংক্রান্তির মুখে চাষীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে সুবরে-গান গায়, তার মধ্যে কালীবাবুর কথা আছে-

❛বকচরেতে কালীবাবু বড় পুণ্যবান,
দেশবিদেশে রাস্তা দিয়ে করেছে খোশনাম।❜

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

আরো পড়ূন

ঝিকরগাছা উপজেলা : ইতিহাস, ঐতিহ্য, তত্ত্ব ও তথ্য

ট্যাগ সমূহ

ঝিকরগাছার ইতিহাস, ঝিকরগাছা উপজেলার ইউনিয়ন, ঝিকরগাছা খবর, গদখালি ঝিকরগাছা, ঝিকরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান, ঝিকরগাছা পোস্ট কোড, ঝিকরগাছা এমপি, ঝিকরগাছা আবহাওয়া, ঝিকরগাছা উপজেলা ম্যাপ, ঝিকগাছার ঐতিহ্য, পানিসারা, ঝিকরগাছা পৌরসভা, ঝিকরগাছা দর্শনীয় স্থান, ঝিকরগাছা বাজার।