যশোর জেলার লোকভাষা [প্রথম পর্ব]


যশোর জেলার লোকভাষা [দ্বিতীয় পর্ব] আঞ্চলিক ভাষা যশোরের ইতিহাস লোকসংস্কৃতি ঝিকরগাছার ভাষা যশোরাদ্য দেশ হোসেনউদ্দীন হোসেন

যশোর জেলা বাংলাদেশের অন্তর্গত একটা প্রাচীন অঞ্চল। এই অঞ্চলটি সুদূর অতীতে একদা একটি স্বাধীন রাজ্য হিসাবে গড়ে ওঠে। এবং অঞ্চলটির প্রশাসনিক নামকরণ হয় 'যশোহর রাজ্য'।

তখন এই অঞ্চলের আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। এই বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটে একটি সমাজ সংস্কৃতির সংস্থাকে কেন্দ্র করে।

এই নতুন সমাজ সংস্থাটির নাম ছিল- 'যশোহর সমাজ'। অর্থাৎ উদ্দেশ্য ছিল সামন্ততান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার এই রাজ্যটিকে আলাদা একটা রূপে ও সত্তায় পরিচিতি দান করা। যশোর সমাজের কার্য ধারাও সেই আদর্শে শুরু হয়েছিল । তখন অভিজাত সমাজে ভাষা ছিল আরবি, ফার্সী, ও দেশী ভাষা মিশ্রিত । অপর ভাষাটি ছিল সম্পূর্ণ লোকভাষা। উচ্চারণের মধ্যেও ছিল বিশেষ পার্থক্য।

যেসব ব্যক্তিগণ ‘যশোহর সমাজের' অন্তর্গত ছিলেন, তাদের সুশিক্ষার জন্য ব্যবস্থা ছিল গুরু গৃহ, পাঠশালা কিংবা টোল। বর্ণমালার মাধ্যমে তারা উচ্চারণের পদ্ধতি এবং ভাষা লেখার কৌশল শিখতো। অনভিজাত শ্রেণীর জন্য ভাষা উচ্চারণ বা শিক্ষার কোনো সুব্যবস্থা ছিল না। অর্থাৎ জনসাধাণের বিরাট একটা অংশ, যারা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সংগে সংশ্লিষ্ট ছিল, তাদের মুখের ভাষা ছিল সম্পূর্ণ লৌকিক এবং নিজস্ব ও স্বকীয়তায় পরিপূর্ণ অভিজাত শ্রেণির ভাষার মধ্যে দরবারী ভাষার প্রাধান্য ছিল বেশী।

নিজেদের কুলীনতার স্বার্থে তারা সচরাচর ব্যবহৃত লোকভাষাকে উপেক্ষা করতেন । সম্মান করতেন দরবারী ভাষাকে । 'বাড়ি' কে তারা 'বাড়ি' বলতেন না, বলতেন ‘বাটী'। 'জন্য' শব্দটির পরিবর্তে 'নিমিত্ত' শব্দটি চালু করেছিলেন এবং 'কাজ'-কে বলতেন কাৰ্য। আরও যে শব্দগুলি অহরহ ব্যবহার করতেন—সে শব্দগুলি হলো : আখের, আচানক, আদব, আদাব, আমল, আমানত, আসারি (ছাদহীন হাওদা), আরজ, আরজাদাস্ত, আশরুপি, আশাবরদার, ইক্তিয়ার, ইনাম, ইশারা, উকিল, উসুল, একজাই, একরাম, এতলা, এমারত, এলবাস, ওগয়রহ, ওজির, ওজিরজাদা, ওফাত, ওয়াকিয় ওস্তাদ, কএদ, কবজ, কবুল, করার (প্রতিজ্ঞা), কাছারি, কাজিয়া, কানুনগো, কারওয়ান, কেল্লা, খয়রাত, খাতের জমা, খাতিরদারি, খানসামানি, খালিসা, খেতাব, খেদমত, খেলাত, গঞ্জ, গাফিল, গাবত (বিনষ্ট), গোলাম, চোপমার, ছাফ, ছে মহলা, জিম্মা, জাঁহাপনা, তক্ত, তকসিব, তদবির, তফসিল, তরফ, তরোবতর (নানা প্রকার), তহখানা, তহশিল, তাগিদ, তাহুত (দেয় খাজনা), তেজারত তেলকারি, তোষাখানা, দপ্তর, দপ্তরখানা, দহলিজ, দরখাস্ত, দস্ত খতি, দাখিল, নকীব, নজর, নায়েব, নেজা(বর্গা), পাঞ্জা,পশন্দ, পোদ্দার, পোস্তাফরমাশ, ফশাদ, বকসিস, বজাজ (বস্ত্র বিক্রেতা), বদস্তুর, বকরন্দাডিজ, বরকবারি, বরাবরি, বহাল, বাগ, বাগিচা, বাদশাহ, বাদশাহী, বালাখানা, বিদায়, বে-এক্তিয়ার, বেওয়ারিশ, মক্তব, মজবতি, মঞ্জুর, মনছব, মসনব, মফস্বল, মুলুক, মহল, মহাল, মানা, মাল, মালখানা, গালগুজাবি, মুছদ্দি (মুৎসদ্দি), সাগরেদ, এলম, মুছল্লি, গোনাগার, শের, দিলদার, কুদরত, বাহানা, আলিশান, মুজুরা (দরবার), মুরচা, মুহরি, মেওয়া, মেরামত, যাইপনা, রসদ, রাহ, রেয়রত, লওয়াজমা (যাবতীয় জিনিস), লস্কর, লাচার, সরঞ্জাম, সরবসর (সোজাসুজি), সরহদ, সরেক, সামিয়ানা, সিক্কা, সিক্কামারা (টাকা তৈরি করা), সুবা, সুবাদারি, সুমার, সোর (শব্দ), হাজির, হিসা, হুজুর, হিম্মত ইত্যাদি। উপরোক্ত শব্দ গুলির মধ্যে অনেক শব্দই ক্রমান্বয়ে দৈনন্দিন লোকভাষায় রূপান্তর লাভ করেছে। আবার অনেক শব্দই প্রচলনের অভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে । অর্থাৎ যে শব্দগুলি ছিল কৃত্রিম তা জনগণ গ্রহণ করেনি । স্বাভাবিকভাবে সেই শব্দগুলির মৃত্যু ঘটেছে। সেই আমলের ভাষার কিছুটা নিদর্শন পাওয়া যায় রামরাম বাসুর 'রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র' গ্রন্থে। নিচের অনুচ্ছেদটি পাঠ করলেই বোঝা যাবে যে সেই আমলে যশোর অঞ্চলের অভিজাত সমাজের ভাষা ছিল কি রকম :

'একদিন রাজার এক সহিলি পলায়ন করিয়া কোথায় ছিল, তাহার ঠেকানা ছিল না। পরে চৌকিতে ধরা পড়িল। রাজা তাহার নষ্ট ক্কয়ার সাজা নিমিত্তে দুইস্তন কাটিয়া ফেলিল। ছুকরী স্তন কাটা জ্বালাতে নিতান্ত কাতর হইয়া প্রাণত্যাগ করিতে করিতে বলিল, রাজা আমাকে বৃহত্ জন্ত্রনা দিয়া নষ্ট করিলা কিন্তু তোমার সর্ব্বনাশ হওনের সময় উপস্থিত জানিও। তাহারও আর বিস্তর কাল অপিক্ষা নাই। ত্বরাই সংহার হইব। এই কহিতেই প্রাণত্যাগ করিল।

'ঠিকানা', 'ছুকরী', ‘জ্বলাতে’, ‘করিলা', 'হওনের’, ‘অপিক্ষা', ‘হইবা’,

শব্দগুলি তৎকালীন যশোর অঞ্চলের লোকভাষা থেকে রামরাম বসু গ্রহণ করেছিলেন।

মোগল আমলের পর যশোরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভিন্নরূপ নেয়। আঠারো শতকের শেষ দিকে কোম্পানী সরকার যশোহরকে জেলা হিসাবে রূপান্তরিত করে। ফলে ইংরেজি শব্দ নানা প্রয়োজনে স্বাভাবিক নিয়মে কথ্য ভাষার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে যায়। উদাহরণ : চেয়ার, টেবল, বেঞ্চ, শ্লেট, পেনসিল, স্কুল, কোর্ট, জজ, মাস্টার, অপিস, পিয়ন, জেল, নম্বর, গ্লাস, ক্লাস, ডক্টর, পকেট, ফটো, প্লান ইত্যাদি।

চেয়ার শব্দটি লোকভাষায় রুপান্তরিত হয়েছে চিয়ার, টেবল হয়েছে টেবিল, বেঞ্চ হয়েছে বেন্‌চি, শেট হয়েছে ছেলেট, পেনসিল হয়েছে পেনছিল, স্কুল হয়েছে ইস্কুল, কোর্ট হয়েছে কোর্ট, জজ হয়েছে জোয়াজ, মাস্টার হয়েছে মাসটের, নম্বর হয়েছে লম্বর, গ্লাস হয়েছে গেলাস, ক্লাস হয়েছে কিলাস, ডক্টর হয়েছে ডাগদার, পকেট হয়েছে পগেট, ফটো হয়েছে ফটোক। প্লান হয়েছে পিলান ইত্যাদি।

যশোর অঞ্চলে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার ইংরেজ আমলের শুরু থেকেই প্রাধান্য পেয়েছে। তার কারণ হলো এই যে, পূর্বে স্থানটি ছিল কলকাতার লাগোয়া। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে কলকাতার পরেই যশোরের ইংরেজ সাহেবদের বসবাসের এবং ব্যবসা-বাণিজ্যর উপযুক্ত স্থান। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যশোর অঞ্চল ছিল ইংরেজ ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আঠারো শতকের শেষলগ্নে (১৭৯৫) যশোরেই প্রথম ফ্যাক্টরী শিল্পের পত্তন ঘটিয়েছিল ইংরেজ ব্যবসায়ীরা : The manufacture of indigo by British entrepreneurs began in Jessore when Bond, a free merchant established a factory at Rupdia near Jessore town in 1795. He wanted to establish another factory at Alinagor near Nowapara. In the beginning of 1796 tuft, another British citizen, obtained per-mission to start indigo works in Mohammadshahi. Taylor established indigo factories at Mirpur in 1800 and in the same year gennings opend an indigo factory at Jhikargacha, nine miles west of Jessore. Doctor Anderson, civil surgean of Jessore, also started indigo works in 1801 and established factories at Barandi and Nilgonj. Within a very short time, the application for cultivating indigo in new lands and for establishment of factories began increases in number and Jessore was over crowded with indigo factories by 1811. This rapid increase in the cultivation of indigo and the establishment of factories may particularly be ascribed to the factories firstly, the soil and weather conditions of Jessore were quite suitable for cultivation; and pecend Jessore was closed to and well connected with calcutta.

যেমন কারখানায় শিল্প উৎপাদনের পত্তন ঘটিয়েছিল, ঠিক তেমনি যশোরকে কেন্দ্র করে ইংরেজি বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই বিদ্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শ্রীরামপুর মিশনারী কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে। খৃষ্টান মিশনারীরা বাংলায় ইংরেজি শিক্ষা চালু করার জন্য প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৭৯৪ খৃস্টাব্দে প্রথম কলকাতায় ধর্মতলায় ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং একই বছরে শ্রীরামপুরে মিশনারীরা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এর পরপরই যশোরে শুরু হয় ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ-এর ফলে ইংরেজদের প্রভাবে যশোরের কথ্য ভাষায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা দেয় এবং আজও তা বাংলায় ব্যবহার হচ্ছে।

চলবে....

লেখক : হোসেনউদ্দীন হোসেন
মূল প্রবন্ধ : যশোর জেলার লোকভাষা ও লোকসংস্কৃতি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

ট্যাগ সমূহ

ঝিকরগাছার ইতিহাস, ঝিকরগাছা উপজেলার ইউনিয়ন, ঝিকরগাছা খবর, গদখালি ঝিকরগাছা, ঝিকরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান, ঝিকরগাছা পোস্ট কোড, ঝিকরগাছা এমপি, ঝিকরগাছা আবহাওয়া, ঝিকরগাছা উপজেলা ম্যাপ, ঝিকগাছার ঐতিহ্য, পানিসারা, ঝিকরগাছা পৌরসভা, ঝিকরগাছা দর্শনীয় স্থান, ঝিকরগাছা বাজার।