সেকালের ব্রাহ্মণ নগরী, একালের লাউজানী

রাজা মুকুট রায়ের রাজধানীর সাতশো বছরের ইতিহাস

সাতশো আগের কথা। নদীর নাম ছিল হরিহর। তার তীরে সারি সারি নৌবহর সাজানো, হাতে তীর-ধনুক নিয়ে প্রস্তুত শত শত নৌ-প্রতিরক্ষা সৈন্য। শঙ্খমালায় বাঁধানো নদীর পাড়জুড়ে দাঁড়িয়ে আকাশছোঁয়া এক মণিমুক্তাখচিত রাজপ্রাসাদ। প্রাসাদের পাশে রয়েছে বিশাল হাতিশালা ও ঘোড়াশালা। বলছি দক্ষিণ বঙ্গের ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের মহাপ্রতাপশালী রাজা মুকুট রায়ের রাজধানী — ব্রাহ্মণ নগরের কথা।

যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার এক সাধারণ গ্রামের নাম লাউজানী। কিন্তু এই সাধারণতার অন্তরালে লুকিয়ে আছে এক গৌরবময় অতীত — প্রায় সাতশো বছরের পুরনো ইতিহাস। রাজা মুকুট রায়ের রাজ্য বিস্তৃত ছিল উত্তরে মহেশপুর থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এবং পশ্চিমে গঙ্গার তীর পর্যন্ত। এই বিশাল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল ব্রাহ্মণ নগর — আজকের লাউজানী। ধারণা করা হয়, নগরটিতে প্রায় ১৬০০ ব্রাহ্মণ পরিবার বসবাস করত, সেই থেকেই এর নাম ‘ব্রাহ্মণ নগর’।

ইতিহাস বিশ্লেষণে জানা যায়, ব্রাহ্মণ নগর ছিল সুসংগঠিত ও সুরক্ষিত। রাজপ্রাসাদের অনুমতি ব্যতীত কোনো পশুপাখিও শহরে প্রবেশ করতে পারত না। বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে স্থল ও জলপথে গড়ে তোলা হয়েছিল দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা বলয়। নগরীর চারপাশ দিয়ে প্রবাহিত ছিল দুটি নদী — গঙুড়ে ও হরিহর। আজ গঙুড়ে নদীর আর কোনো অস্তিত্ব নেই, কিন্তু হরিহর এখনো মৃতপ্রায় অবস্থায় অতীতের স্মৃতি বহন করে চলছে।

সুরক্ষিত ব্রাহ্মণ নগর ছিল ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ। শুধু রাজপরিবার নয়, সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রাও ছিল উন্নত ও সুসংহত। সে যুগেই নির্মিত হয় অসংখ্য ইমারত, মন্দির ও পাকা সড়ক। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া সেই স্থাপত্যের কিছু ধ্বংসাবশেষ আজও চোখে পড়ে।

প্রাচীন এক পুথিতে ব্রাহ্মণ নগর সম্পর্কে লেখা আছে:

❝জানিবা তাহার নাম ব্রাহ্মণ নগর
চারিদিকে নদী তার দেখিতে সুন্দর
সোনা দিয়ে বান্দিয়াছে ঘাট চারিখান
প্রতি ঘাটে চারিশত সোনার নিশান
হেন পুরী নাহি ওগো ছিল রাবণের
মুকুট নামের রাজা সেই তো দেশের❞

সুসজ্জিত ব্রাহ্মণ নগরের জাঁকজমকের আর কোনো দৃশ্যমান চিহ্ন নেই। একটি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখা গেলেও ইতিহাসবিদদের মতে, তা মুকুট রায়ের শাসনামলের নয়। স্থানীয় বাসিন্দারাও এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে পারেন না। তবে কিছুকাল আগে ‘মৃতঞ্জয় কূপ’ নামে এক প্রাচীন কুয়ার সন্ধান মেলে, যেটিকে রাজবাড়ীর অংশ বলে মনে করা হয়। লোককথা অনুযায়ী, এই কূপের পানিতে মৃত প্রাণীকেও জীবিত করা যেত। যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের দেহে এই কূপের জল ছিটিয়ে পুনর্জীবিত করা হতো। সেই জন্যই রাজা মুকুট রায়কে পরাজিত করা প্রায় অসম্ভব ছিল। যদিও এই কাহিনীর ঐতিহাসিক ভিত্তি আজও প্রমাণিত নয়।

জনশ্রুতি রয়েছে, ঐতিহাসিক গাজী কালুর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজা মুকুট রায় আত্মহত্যা করেন। তিনি ছিলেন চরম মুসলিম বিদ্বেষী; তার শাসনামলে কোনো মুসলমান ব্রাহ্মণ নগরে প্রবেশাধিকার পেত না। তবে তার মৃত্যুর পর মুসলমানরা এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। সময়ের প্রবাহে ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গিয়ে ব্রাহ্মণ নগর একসময় পরিণত হয় আজকের লাউজানী গ্রামে।

রাজা মুকুট রায় ও গাজী-কালী-চম্পাবতীর পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত ইতিহাস জানতে পড়তে পারেন এই লেখাটি >>

লেখাটি পড়তে ছবিতে অথবা এখানে ক্লিক করুন


Search Tags
গাজী কালুর মাজার কোথায়, গাজী কালুর কিচ্ছা, গাজী কালু ও চম্পাবতীর পালা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দাও, গাজী বংশের ইতিহাস, গাজী কালুর গান, গাজী কালুর জীবনী, 
গাজী কালুর পুথি pdf, গাজী কালু চম্পাবতীর পুথি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

আরো পড়ূন

ঝিকরগাছা উপজেলা : ইতিহাস, ঐতিহ্য, তত্ত্ব ও তথ্য

ট্যাগ সমূহ

ঝিকরগাছার ইতিহাস, ঝিকরগাছা উপজেলার ইউনিয়ন, ঝিকরগাছা খবর, গদখালি ঝিকরগাছা, ঝিকরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান, ঝিকরগাছা পোস্ট কোড, ঝিকরগাছা এমপি, ঝিকরগাছা আবহাওয়া, ঝিকরগাছা উপজেলা ম্যাপ, ঝিকগাছার ঐতিহ্য, পানিসারা, ঝিকরগাছা পৌরসভা, ঝিকরগাছা দর্শনীয় স্থান, ঝিকরগাছা বাজার।