লেখাটি সতীশচন্দ্র মিত্রের কালজয়ী ইতিহাসগ্রন্থ 'যশোহর-খুলনার ইতিহাস '(২য় খণ্ড) থেকে সংকলিত। প্রকাশকাল: ১৯১৪।
রাজা মুকুট রায়
মুকুট রায়ের বাড়ী ছিল, ব্রাহ্মণনগর। যশোহর জেলায় যেখানে বর্তমান ঝিকারগাছা রেলওয়ে-ষ্টেশন অবস্থিত, তাহার কিঞ্চিৎ পূর্ব্বোত্তর কোণে লাউজানি বলিয়া গ্রাম আছে। ঐ লাউজানিই ছিল এক সময় ব্রাহ্মণ-নগর। উহা কাপোতাক্ষের কূলে অবস্থিত। কিন্তু পূর্ব্বে যেরূপ উহার অবস্থান ছিল, এখন আর তেমন নাই। তখন ব্রাহ্মণনগরের পশ্চিম ভাগে সুবিস্তীর্ণ কপোতাক্ষ এবং দক্ষিণসীমা দিয়া হরিহর নদ প্রবাহিত হইত; উত্তর পূর্ব্ব দিকে বিল ছিল। ইহার মধ্যে পরিখাবেষ্টিত দুর্গে রাজা মুকুট রায় বাস করিতেন। তিনি গুড়গাঞিভুক্ত শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ ছিলেন। পাঠান আক্রমণের পূর্ব্ব হইতে গুড়গাঞিভুক্ত ব্রাহ্মণেরা যশোহর-খুলনার নানা স্থানে নদীতীরে বাস করিতেন।
তাঁহারাই এক সময়ে চেঙ্গুটিয়া পরগণার রাজা ছিলেন। আমরা পূর্ব্বে দেখাইয়াছি দক্ষিণডিহি প্রভৃতি স্থানের রায় চোধুরী উপাধিভূষিত গুড়ব্রাহ্মণেরা কিরূপে খাঁনজাহানের অভিযানের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়াছিলেন, এবং পরে কিরূপে এই বংশীয় কামদেব ও জয়দেব মহম্মদ তাহেরের কৌশলে পীরালি-মুসলমান হইয়া যান। স্বধৰ্ম্মনিষ্ঠ মুকুট রায় প্রবল প্রতাপে শাসনকার্য্য করিতেন। তাঁহার রাজ্য উত্তরে মহেশপুর হইতে দক্ষিণে সমুদ্র পর্যান্ত বিস্তৃত ছিল। পশ্চিম দিকে এ রাজ্য গঙ্গা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করিয়াছিল। এই শাসনকার্য্যে তাঁহার দক্ষিণহস্তস্বরূপ ছিলেন তাঁহার আত্মীয় ও সেনাপতি দক্ষিণ রায়। দক্ষিণ রায়ও ব্রাহ্মণ এবং দেবভক্তিপরায়ণ। রাজধানী ব্রাহ্মণনগরে মুকুটেশ্বর শিবমন্দির ছিল, দক্ষিণরায় মন্দিরে গিয়া শিবপূজা না করিয়া জলগ্রহণ করি-তেন না। অধিবাসীর সংখ্যা অধিকাংশ ব্রাহ্মণ ছিল বলিয়া নগরের নাম ব্রাহ্মণ-নগর হইয়াছিল। মুকুট রায় অতিরিক্ত যবনদ্বেষী ছিলেন; তখন সম্যক্ শাসন বিস্তৃত না হইলেও দেশ যবনাধিকারভুক্ত ছিল। কিন্তু তবুও মুকুট রায় যবনের আধিপত্য স্বীকার করিতেন না, যবনের মুখ দর্শন করিতেন না, কোনও কারণে যবন দর্শন করিলে তজ্জন্য প্রায়শ্চিত্ত করিতেন। শাসনের সুব্যবস্থার জন্য মুকুট রায়ের রাজ্য দুইভাগে বিভক্ত ছিল; তন্মধ্যে উত্তর ভাগ তিনি নিজে শাসন করি-তেন; তজ্জন্য তাঁহার অধীনে যথেষ্ট পদাতিক ও অশ্বারোহি-সৈন্য ছিল; দক্ষিণ দেশ বা ভাটি মুল্লুকের শাসনভার দক্ষিণ রায়ের হস্তে সমর্পণ করিয়াছিলেন। এ জন্য তাঁহাকে লোকে ভাটীশ্বর এমন কি আঠার ভাটির রাজ্যেশ্বর বলিত।
এজন্য তাঁহার রীতিমত নৌ-বাহিনী ও নৌ-সৈন্য ছিল। এই ভাটি দেশে কাঠ, মধু, মোম প্রভৃতি হইতে আয়ও কম হইত না। সুন্দর বন তখন উত্তর দিকে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, এবং ভীষণ ব্যাঘ্র প্রভৃতির উৎপাত ছিল। দক্ষিণ রায় তেমনি বলবান্ পুরুষ ছিলেন; তিনি তীর ধনুক ও অস্ত্র সাহায্যে বহু ব্যাঘ্র ও কুমীর শিকার করিতেন এবং প্রয়োজন হইলে মল্লযুদ্ধেও সুন্দর বনের বাঘের মুণ্ডপাত করিতে পারিতেন। অতিরঞ্জিত হইলে এই সকল গল্প কতদূর প্রসার লাভ করিতে পারে, তাহা সহজেই অনুমেয়। বস্তুতঃ দক্ষিণ রায় এই বলবীর্য্যের পুরস্কারস্বরূপ সুন্দর বনের ব্যাঘ্রভীতিনিবারক দেবতারূপে পূজিত হইয়া আসিতেছেন।
এই ব্যাঘ্রের দেবতার পূজাপদ্ধতি প্রচার জন্য অনেকেই লেখনী ধারণ করিয়াছেন, তন্মধ্যে মাধবাচার্য্য এবং নিম্না গ্রামনিবাসী "রায়মঙ্গল"-প্রণেতা কৃষ্ণরাম দাসই প্রধান। রায় মঙ্গল হইতে জানা যায় প্রভাকর নামে এক রাজা ছিলেন, তিনি চব্বিশ পরগণার দক্ষিণাংশে বন কাটাইয়া রাজ্য স্থাপন করেন। তিনি শিবের বরে দক্ষিণরায় নামক পুত্র লাভ করেন। দক্ষিণ রায়ের আর এক ভ্রাতা বা বন্ধু ছিলেন কালু রায়। এই কালু রায়ের সহিত গাজীর সহচর কালুর কোন প্রকার সম্পর্ক নাই।
সম্ভবতঃ প্রভাকরের পুত্র দক্ষিণ রায় হাতিয়াগড় প্রদেশে আজন্ম ব্যাঘ্র শিকার প্রভৃতি কার্য্যে রত থাকিয়া, সুন্দর বনে শাসন বিস্তার কার্য্যে পিতার সহায়তা করিয়া বিশেষ অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তাঁহার বীরত্বের খ্যাতি মুকুট রায়ের নিকট পৌঁছিয়াছিল; তিনি সেই বীর যুবককে স্বীয় কার্য্যের সহায়ক রূপে গ্রহণ করেন। রাজার ধনবল ও জনবল দ্বারা পৃষ্ঠপোষিত হইয়া, বিস্তীর্ণ নদীবক্ষে বা জঙ্গলাকীর্ণ সুন্দর বনে শত্রু শাসন করিতে করিতে এমন রণপাণ্ডিত্য লাভ করেন, যে তাঁহার ভয়ে কেহ সুন্দর বনে প্রবেশ করিতে সাহসী হইত না। দক্ষিণ রায়ও মুকুট রায়ের মত যবনদ্বেষী ছিলেন। এই যবনদ্বেষই তাঁহাদের কালস্বরূপ হইয়াছিল। এই জন্যই গাজী তাঁহাদের উপর অত্যাচার করিতে অগ্রসর হন।
এই স্থানে আমরা ধীর ভাবে কয়েকটি কথা বিচার করিব। আমরা চারি জন মুকুট রায়ের উল্লেখ করিয়াছি। তন্মধ্যে প্রথম দুই জনের সহিত প্রস্তাবিত ইতিহাসের বিশেষ কিছু সম্বন্ধ নাই। তৃতীয় জনকে আমরা রায় মুকুট বলি-য়াছি; চতুর্থ জনকে বলিয়াছি মুকুট রায়। এই দুই জনকে এক ব্যক্তি বলিয়া অনেকে সন্দেহ করিয়াছেন। যিনি ঝিনাইদহের মুকুটের কথা বলিতে গিয়াছেন, তিনি জনশ্রুতির উপর নির্ভর করিয়া বলিয়াছেন যে তাঁহার একটি রাজধানী দক্ষিণ দিকে ছিল; কিন্তু সে মুকুটের সহিত গাজীর যুদ্ধ বা চম্পাবর্তী নামক তাঁহার কোন কন্যার কথা উল্লিখিত হয় নাই। অপর পক্ষে যিনি ব্রাহ্মণ নগরের মুকুটের কথা বলিয়াছেন, তিনি অনুমান করিয়াছেন যে, তাঁহার রাজ্য উত্তর দিকে অনেক দূর বিস্তৃত ছিল; কিন্তু তিনি নবাব সৈন্যের সহিত যুদ্ধের কথা বিশেষ কিছু বলেন নাই। আমরা মনে করি, এই দুই জন স্বতন্ত্র ব্যক্তি। তাহার কয়েকটি কারণ সংক্ষেপতঃ এই-(১) রায়মুকুট পারি-শ্রোত্রিয় এবং মুকুট রায় গুড়-শ্রোত্রিয়, যদিও শেষোক্ত জনের সামাজিক নিদর্শন সম্বন্ধে জনশ্রুতি ভিন্ন বিশেষ প্রমাণ নাই। (২) রায় মুকুটের চম্পাবতী নামে কোন কন্যার কথা পাওয়া যায় না। (৩) রায় মুকুটের সহিত গাজীর যুদ্ধ হয় নাই বা দক্ষিণ রায়ের সহিত তাঁহার সম্বন্ধের উল্লেখ নাই। (৪) রায় মুকুট যুদ্ধে বন্দী হইয়া রাজধানীতে নীত হইয়াছিলেন; মুকুট রায় বন্দী হইবার পূর্ব্বেই কূপে পড়িয়া আত্মঘাতী হইয়াছিলেন। (৫) রায় মুকুট নবাব-সৈন্যের সহিত যুদ্ধ কালে পরিবারবর্গ শৈলকূপার সন্নিকটে কোন দুর্গে রাখিয়াছিলেন, সেখানে তাঁহার স্ত্রী-কন্যার মৃত্যু হয়। অথচ প্রবাদ অনুসারে অন্য মুকুট রায়ের পরিবার-বর্গ ব্রাহ্মণনগরে কূপে পড়িয়া আত্মহত্যা করেন। সুতরাং রায়মুকুট ও মুকুট রায় এক ব্যক্তি নহেন, এবং তাঁহারা এক সময়ে প্রাদুর্ভূত হন নাই। সম্ভবতঃ ব্রাহ্মণনগরের মুকুট রায় হোসেন সাহ ও তৎপুত্র নসরৎ সাহের রাজত্ব কালে অর্থাৎ ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে আবির্ভূত হন এবং ঝিনাইদহের রায় মুকুট তাঁহার অনেক পরে অর্থাৎ মোগল-আমলের প্রথম ভাগে আত্ম-প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এইরূপ অনুমান করিবার কি কারণ আছে, তাহা পরে বলিব। আমরা এখানে রাজা মুকুট রায়ের কথাই বলিতেছি।
মুকুট রায়ের স্ত্রীর নাম লীলাবতী ও তাঁহার সাত পুত্র এবং একটি মাত্র কন্যা। সাত ভ্রাতার ভগিনী বলিয়া ভগিনীটি সকলেরই বিশেষ আদরের ছিল; এরূপ আদরের ভগিনীর প্রসঙ্গ উঠিলে আমাদের এখনও "সাত ভাই চম্পার" কথা অনেকে বলিয়া থাকে। চম্পাবতী অপূর্ব্ব রূপ-লাবণ্যবতী ছিল; এমন কি তাহার রূপের কথা নানা স্থানে ব্যাপ্ত হইয়াছিল। গাজী সেই রূপের খ্যাতি শুনিয়াই মুগ্ধ হইয়াছিলেন। তিনি মুকুট রায়ের মুসলমান-বিদ্বেষের কথা জানি-তেন। সেই ধৰ্ম্মবিদ্বেষের জন্য প্রতিহিংসা লইবার কল্পনাই হউক বা প্রকৃত রূপমোহেই হউক, গাজী চম্পাবতীর সহিত বিবাহের প্রস্তাব করিবার জন্য কালুকে পাঠাইলেন। মুকুট রায় যবনের দুঃসাহসিক প্রস্তাবে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হইয়া কালুকে কারাবদ্ধ করিলেন। সুলতান হোসেনসাহ মুকুট রায়ের যবন-বিদ্বেষের কথা পূর্ব্ব হইতে জানিতেন এবং পরে গাজীর বর্ণনা হইতে তাহা বুঝিয়া লইয়া উহার প্রতিশোধ দেওয়া জাতিগত কর্তব্য বলিয়া ধরিয়া ছিলেন। গাজী সোণারপুর প্রভৃতি স্থান হইতে নৌকাপথে অনেক সৈন্য লইয়া আসিয়া-ছিলেন, হুসেন সাহের সৈন্যদলও আসিতেছিল। যেন সকল আয়োজন ও অভিযান কালুর কারামোচনের জন্যই হইতেছিল।
দক্ষিণ রায় এ যুদ্ধের জন্য অপ্রস্তুত ছিলেন না। দক্ষিণ দিক্ হইতে যখন গাজীর সৈন্য আসিবার উপক্রম হইতেছিল, তখন তিনি ত্বরিত গতিতে নৌ-বাহিনী সাজাইয়া লইয়া অতর্কিত ভাবে গাজীর সৈন্যের উপর পড়িলেন, এবার গাজীকে পরাজিত হইয়া পলায়ন করিতে হইয়াছিল। শুনা গিয়াছে, ইছামতী-তীরে তারাগুণিয়া গ্রামে সৈয়দ সাদাউল্লার বাটীতে গাজী সাহেব আশ্রয় লইয়া। ছিলেন। পরে গাজী সমস্ত সংবাদ সুলতান হুসেন সাহের নিকট গিয়া অতি-রঞ্জিত ভাষায় বর্ণনা করিলেন। গাজীর পরাজয়, কালুর কারাবাস, মুসলমানের অপমান, হিন্দুরাজন্যের অবাধ্যতা-সকল একত্র করিয়া এক ধর্মযুদ্ধের কারণ উপস্থিত করিল। গৌড়েশ্বরের সৈন্যসমূহ জাতীয় মর্য্যাদার জন্য মুকুট রায়ের বিরুদ্ধে প্রেরিত হইল। হিজলী ও হাতিয়াগড় প্রদেশ হইতেও গাজী সাহেব অনেক সৈন্য সংগ্রহ করিয়া লইয়া আসিলেন। দক্ষিণ রায় ও নদীতীরসমূহ উৎসন্ন ও বাসশূন্য করিয়া, খাদ্যদ্রব্য দূরীভূত বা ভূপ্রোথিত করিয়া, যেখানে সেখানে গুপ্ত সৈন্য সংস্থাপন করিয়া শত্রুর আগমন-পথ কণ্টকময় করিয়া তুলিয়াছিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না।
গাজী কালুর পুঁথিতে আছে, গাজী কতকগুলি ব্যাঘ্র লইয়া ব্রাহ্মণনগরের নিকট উপনীত হইলেন এবং ব্যাঘ্রদিগকে মেষ করিয়া লইয়া গুপ্তভাবে নগরে প্রবেশ করিলেন। এ ব্যাঘ্র সুন্দর বনের চতুষ্পদ ব্যাঘ্র বলিয়া বিশ্বাস করি না, তবে ইহারা সুন্দর বনের অসভ্য মল্লজাতীয় বলশালী সৈন্য হইতে পারে। মোট কথা, গাজী গুপ্ত ভাবে নগরীতে প্রবেশ করিলেন। অন্য দিক্ হইতে গৌড়ে-শ্বরের সেনা আসিল। কয়েক দিন ধরিয়া ভীষণ যুদ্ধ চলিল। মুসলমানেরা পুরীর মধ্যবর্তী কূপের জলে গো-রক্ত প্রভৃতি নিক্ষেপ করিয়া বিষাক্ত করিয়া দিল।। অবশেষে মুকুট রায় পরাজিত হইলেন। তখন দক্ষিণ রায় অন্য সৈন্য লইয়া দক্ষিণ দিকে ছিলেন। মুকুটের পরিবারবর্গ অধিকাংশই কূপে পড়িয়া আত্ম-হত্যা করিলেন। কেবলমাত্র মুকুটের সর্ব্বকনিষ্ঠ পুত্র কামদেব ও কন্যা সুভদ্রা বা চম্পাবতী বন্দী হইলেন। শত্রুরা ইঁহাদের উভয়কেই অখাদ্য খাওয়াইয়া মুসলমান করিয়া দিয়াছিল। কেহ বলেন গাজী সাহেব চম্পাবতীকে বিবাহ করিয়াছিলেন, মুসলমানী পুঁথিতে আছে গাজী সাহেব চম্পাবতীকে বিবাহ করি-বার কিছু দিন পরে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন; আবার কেহ বলেন, গাজী সাহেব চম্পাবতীকে বিবাহ করেন নাই, বিবাহ করিবার প্রস্তাবনা ছল মাত্র; যবনদ্বেষী মুকুট রায়কে শাসন করাই উদ্দেশ্য ছিল। গাজীরা হিন্দুর সহিত বিবাদ করিতেন, বা হিন্দু জাতির উপর অত্যাচার করিতেন, সে শুধু ধর্ম্মের জন্য। অন্যান্য গাজীদিগের চরিত্র আলোচনা করিলে বিশ্বাস হয় না যে গাজীসাহেব নর-পিশাচদিগের মত ইন্দ্রিয়সেবী ছিলেন। এ বিষয়ে মুসলমানী পুঁথিতে গাজী সাহেবের কামুকতার যে বিস্তৃত কাহিনী আছে, তাহা সম্পূর্ণ অলীক বলিয়া বোধ হয়। উক্ত পুঁথিতেই আছে যে কালু গাজী সাহেবের চরিত্র-পতন দেখিয়া বারং-বার ভর্ৎসনা করিতেছেন। যাহা হউক, গাজীর সহিত চম্পাবতীর বিবাহান্তে বা বিবাহের পূর্ব্বে, সেই রাজকুমারী কোন আত্মীয়ের সাহায্যে পলায়ন করিয়া সাতক্ষীরার গণরাজার আশ্রয় লন এবং অবশিষ্ট জীবন মনস্তাপে, স্বজন-শোকে, আত্মচিন্তায় ও ধৰ্ম্মসাধনায় অতিবাহিত করেন। তাঁহার যাহা কিছু ধনরত্ন ছিল, তাহা সৎকার্য্যে ব্যয়িত করিয়া পরসেবায় এমন ভাবে তাঁহার আদর্শ জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন, যে জাতিধৰ্ম্ম-নির্বিশেষে সর্ব্বলোকে তাঁহাকে "মা" বলিয়া ডাকিত, মায়ের মত ভক্তি করিত, তাঁহার নাম হইয়াছিল "মাই চম্পা বিবি।” তাঁহার মৃত্যুর পর এই মাতৃদেবীর ভক্তবৃন্দ তাঁহার স্মৃতিরক্ষার জন্য তাঁহার সমাধির উপর একটি সুন্দর ও বৃহৎ এক-গুম্বজ মন্দির নির্মাণ করিয়া দেয়। সাতক্ষীরার সন্নিকটে লাপ্সা গ্রামে এই বিখ্যাত "মাইচাম্পার দরগা" মাইচাম্পার পূর্ব্বজীবন নানা অদ্ভুত কাহিনীর অন্তরালে অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে।।।
মুকুট রায়ের শিশুপুত্র কামদেব নানাস্থান ঘুরিয়া অবশেষে বর্তমান গোবর-ডাঙ্গার দক্ষিণে চারঘাটে আশ্রয় লন। তাঁহার নাম পরিবর্তিত হইয়া ঠাকুর-বর হইয়াছিল। তিনি মুসলমান ফকিরের মত চারঘাটে বাস করিতেন। তিনি মুসলমান হইয়াছিলেন বলিয়া ক্রমে সে ধর্ম্মের প্রতি আসক্তি বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্তী কালে তিনি হিন্দুদিগকে মুসলমান করিতে চেষ্টা করিতেন। ঠাকুরবর প্রায় ১০০ বৎসর কাল জীবিত ছিলেন। প্রতাপাদিত্যের উত্থানপতন এবং এমন কি প্রতাপের মৃত্যুর পরে ঠাকুরবর দেহত্যাগ করেন। হরি শৌণ্ডিক বা হ'রে গুঁড়ি নামক একজন প্রসিদ্ধ সমৃদ্ধিসম্পন্ন বণিক্ চারঘাটে বাস করিত। তাঁহাকে মুসলমান ধৰ্ম্ম গ্রহণ করাইবার জন্য ঠাকুরবর অনেক চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু হরি তাহাতে সম্মত হয় নাই। তাহার ফলে ঠাকুরবর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। প্রতাপাদিত্যের সহিত হরি শৌণ্ডিকের বিবাদ ও পতনের মূলে যে ঠাকুরবরের প্ররোচনা ছিল, এরূপ শুনিতে পাওয়া যায়। আমরা দ্বিতীয় খণ্ডে তাহার আলোচনা করিব। হ'রে গুঁড়ি মৃত্যুও শ্রেয়ঃ বোধ করিত, কিন্তু ঠাকুরবরের কথায় ধর্মান্তর গ্রহণ করিতে স্বীকৃত হয় নাই; তজ্জন্য সে অঞ্চলে একটা কথা আছে:-"ম'রলো, তবুও হ'রে গুঁড়ি ঠাকুরবর বল না” অর্থাৎ ঠাকুরবরের বশ্যতা স্বীকার করিল না।
![]() |
গাজীর পট। পটচিত্রে গাজী-কালু-চম্পাবতীর উপাখ্যান। ছবিসূত্র: উইকিপিডিয়া |
দক্ষিণরায় ও গাজীর শেষ কথা
ব্রাহ্মণ নগরের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই দক্ষিণরায়ের পতন হইয়াছিল কিনা সন্দেহ। সম্ভবতঃ দক্ষিণরায়ের সম্মিলিত সৈন্যের সহিত 'সমস্ত মুসলমান সৈন্যের সহিত আর একটি মহা যুদ্ধ হইয়াছিল। ঐ যুদ্ধের প্রকৃত ফল কি হয়, তাহা জানা যায় না। তবে এই যুদ্ধে যে দক্ষিণরায় দমিত হইয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। কেহ বলেন তিনি শেষ যুদ্ধে পরাজিত হইয়া ইষ্টদেবতা সূর্য্যের মন্দিরের সম্মুখে সম্মুখযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন করিয়া, দিব্যধামে গমন করেন। কিন্তু "রায়মঙ্গল” প্রভৃতিতে দেখিতে পাই, তিনি এই যুদ্ধের পর গাজীর সহিত সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হন।
"বড় খাঁ গাজির সাথে, মহাযুদ্ধ খনিয়াতে দোস্তানি হইল তা'র পর।"
এই দোস্তানি বা বন্ধুত্বের ফলে উভয়ে সুন্দরবন অঞ্চলে প্রভু হইয়া বসেন। কিন্তু তাঁহাদের উপর প্রভু ছিল, তাহারা যতই প্রভুত্ব করেন, বনদেবতার স্থান তাহাদের অপেক্ষা উচ্চ। এ সম্বন্ধে রচিত গল্প আছে; "বনবিবির জহুরা নামা"--নামক মুসলমানী কেতাবে বনবিবির কেচ্ছা আছে। ঐ পুস্তকের মূল তাৎপর্য্য এই। মক্কাবাসী বেরাহিমের স্ত্রী গুলাল বিবি, সতীনের কৌশলে গর্ভাবস্থায় সুন্দরবনে পরিত্যক্ত হন। তথায় বনবিবি ও সা জঙ্গুলী নামে তাঁহার কন্যা ও পুত্র ভূমিষ্ঠ হয়। ভাটীশ্বর দক্ষিণরায়ের কবল হইতে দুর্ব্বলকে রক্ষা করিবার জন্য ভগবানের আদেশে বনবিবি ভ্রাতাকে লইয়া ভাটিদেশে থাকিয়া যান। শিবাদহ, চাঁদখালি, রায়মঙ্গল হইতে আন্ধারমাণিক প্রভৃতিস্থান তাঁহাদের অধিকারভুক্ত হয়। দক্ষিণরায় তাহাতে ক্রুদ্ধ হইয়া যুদ্ধোদ্যোগ করিলে, স্ত্রীলোকের সহিত পুরুষের যুদ্ধ অকর্তব্য এই কথা বুঝাইয়া দিয়া দক্ষিণরায়ের মাতা নারায়ণী আসিয়া বনবিবির সহিত যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে নারায়ণী পরাজিত হইলে উভয় পক্ষে সন্ধি হইল, কেঁদোখালি দক্ষিণরায়কে দেওয়া হইল, বনবিবি পরে হাসনাবাদ প্রভৃতি কতকগুলি স্থল নিজে লইয়া আবাদ করিলেন। এই সময় বরিজহাটিতে ধোনাই মোনাই নামে দুই ভাই ছিল। তাহারা সপ্ত ডিঙ্গা সাজাইয়া মোমমধু আনিবার জন্য বাদায় গেল। তাহাদের সঙ্গে গেল জনৈক দুঃখিনী বিধবার একমাত্র পুত্র দু'খে। উহারা গড়খালি পৌঁছিলে দক্ষিণরায় নরবলি চাহিলেন-বাছিয়া চাহিলেন হতভাগ্য দু'খেকে। তাহাই হইল, দু'খেকে কেঁদোখালিতে নিক্ষেপ করা হইল। তখন বনবিবি আসিয়া দুর্ব্বল দু'খের পক্ষ লইলেন। আবার যুদ্ধ বাধিল। এবারও দক্ষিণরায় পরাজিত হইলেন। তখন তিনি গিয়া বনবিবির আনুগত্য স্বীকার করিলেন, তাহার সঙ্গে আর একজন গিয়াছিলেন, তাঁহার নাম বরখান্ গাজী, তিনি সেকেন্দর সাহের পুত্র। উভয়ে বনবিবিকে সেলাম করিয়া দেশে ফিরিলেন-আর দেশে ফিরিল দু'খে। বনবিবির কৃপায় তাহার মাতার অন্ধত্ব ও বধিরত্ব ঘুচিল, দু'খের অতুল সম্পদ্ ও চৌধুরী খেতাব হইল। দু'খে ধনাইএর কন্যা চাম্পাকে বিবাহ করিল। বনবিবির পূজা প্রচার হইল।
বনবিবি মনুষ্য হইয়াই যখন দেবতা হইয়া গেলেন, তাঁহার অনুগত বীর দক্ষিণরায় কেন দেবতা হইবেন না? চিরজীবন ব্যাঘ্রাদি হিংস্র জন্তু শিকার করিয়া যিনি বনবিভাগে বসতির পন্থা খুলিয়া দিয়াছিলেন, সমস্ত সুন্দরবন রাজ্য যাঁহার শাসনপ্রতাপে থরহরি কম্পবান ছিল, মৃত্যুর কিছুকাল পর হইতে তিনি ব্যাঘ্রের দেবতারূপে পূজিত হইলেন। কোথায়ও তাঁহার মস্তকটি পূজা হয়, কোথায়ও বাঘের উপর আসীন গুম্ফ শোভিত ভয়ঙ্কর মূর্তির পূজা হয়।
"কাটা মুণ্ড "বারা” পূজা সেই হ'তে ক'রে কোন খানে দিব্য মূর্তি বাঘের উপরে।”
তিনি ব্যাঘ্রভীতি নিবারক দেবতা। এই জন্য সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহে, বিশেষতঃ ২৪ পরগণার বারুইপুর অঞ্চলে ও আবাদী মহলে এই দেবতার পূজা হয়। ধবধ'বে গ্রামে এই দেবতার এক মন্দির ও তন্মধ্যে তাঁহার মুকুট ও যোদ্ধ বেশধারী এক প্রতিমা আছে। গণেশ-মন্ত্রে ও গণেশের ধ্যানো-ল্লেখ করিয়া এই দেবতার পূজা হয়।
পূর্ব্বে দেখিয়াছি গাজী সাহেব বনবিবির ব্যতা স্বীকার করিলেন। তদনন্তর তিনি পূর্ব্ববঙ্গে ফিরিয়া যান। শ্রীহট্টে তাঁহার মৃত্যু হয়। শ্রীহট্টের অন্তর্গত হবিগঞ্জ উপবিভাগের দক্ষিণ-পূর্ব্বসীমান্তে বিষগাঁও নামক স্থানে গাজী সাহেবের সমাধি আছে। ঐ স্থানের নাম পরে গাজীপুর হইয়াছিল।+ যশোহর খুল্লা অঞ্চলে গাজীর পূজা হয়, হিন্দু মুসলমানে গাজীর সির্ণী দেয়, এবং এক সময়ে "গাজীর গীতের” অত্যন্ত প্রচলন ছিল। আমরা যে গাজীর কথা এতক্ষণ বলিলাম, তিনি পাঁচ পীরের অন্যতম বরখাঁন গাজী। কিন্তু তদ্বিষয়েও মতভেদ আছে।
আমরা পূর্ব্বে দেখাইয়াছি, সেকেন্দর সাহার সহিত বরখান গাজীর পিতা-পুত্র সম্বন্ধ সংস্থাপন করা যায় না। তবে তিনি সেকন্দর সাহের রাজত্বকালে প্রাদুর্ভূত হইতে পারেন। কিন্তু তাহা হইলে ঠাকুরবরের ইতিহাসের সঙ্গে মিলে না। ঠাকুরবর প্রায় ১০০ বৎসর জীবিত ছিলেন। আমরা দেখিব প্রতাপাদিত্যের রাজধানীতে কার্ডালোর হত্যাকালে অর্থাৎ ১৬০৩ খৃষ্টাব্দে বৃদ্ধ ফকির জীবিত আছেন। মুকুটরায়ের মৃত্যুকালে ঠাকুরবরের বয়স যদি ১০ বৎসর হয়, তাহা হইলে উক্ত মৃত্যুর তারিখ আনুমানিক ১৫২০ খৃষ্টাব্দে ধরিতে হয়। তাহার আনুমানিক ২০ বৎসর পূর্ব্বে অর্থাৎ ১৫০০ অব্দে বরখান গাজী সুন্দরবন প্রদেশে আগমন করিয়াছিলেন। সুতরাং তিনি যে সেকন্দর সাহের রাজত্বকালে প্রচারিত হন, তাহা আমরা ধরিতে পারি না। কারণ সেকন্দর সাহের রাজত্বকাল-১৩৫৯ হইতে ১৩৯২ পর্যন্ত, অর্থাৎ একশত বৎসর পূর্ব্ববর্তী। অতএব আমরা ধরিতে চাই যে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে আর এক দল গাজী বাঙ্গালাদেশে আসিয়া হুসেন সাহের সাহায্যে হিজলী হইতে পূর্ব্ববঙ্গ পর্যন্ত ধৰ্ম্মপ্রচার করিতে থাকেন, বরখান্ বা বড়খা গাজী তাঁহাদের অন্যতম।
পাঠান আমলে নানা সময়ে গাজীগণ বঙ্গে আসিয়া ধৰ্ম্ম প্রচার করিতে চেষ্টা করিয়াছেন, তাঁহাদের সহিত নানাসূত্রে হিন্দু বৌদ্ধের বিবাদ হইয়াছে, তদুপলক্ষে নানা গল্প উপকথা জমিয়াছে; নানাস্থানে এই গাজীদিগের আস্তানা ও দরগা আছে; তাঁহাদের অত্যাচার-অবিচার ভাল মন্দ চরিত্রের কথা না জানিয়া সকল জাতীয় লোকে সমভাবে তাঁহাদের প্রতি পীর জ্ঞানে শ্রদ্ধা করে। শূন্য হইতে দেখিলে যেমন বহু দূরবর্তী স্থানের উচ্চতা নীচতা বা দূরত্ব সব সমান হইয়া যায়, আমরা এই দূরবর্তী কালে জানিয়া, গাজীদিগের মধ্যে কে অগ্রে কে পরে আসিয়াছিলেন, প্রভৃতি কিছুই নির্ণয় করিতে পারি না।
কেহ কেহ পূর্ব্বোক্ত বরখান্ গাজী ও পীর গোরাচাঁদ বা গোরাইগাজীকে অভিন্ন ব্যক্তি বলিয়াছেন। সুতরাং মুকুটরায়ের সহিত যুদ্ধ বিগ্রহও গোরাইগাজী করিয়াছিলেন, ইহাই স্থির হইয়াছে। আমরা ইহার সহিত একমত হইতে পারি না। পীর গোরাচাঁদ সম্বন্ধীয় এক স্বতন্ত্র মুসলমানী পুঁথি আছে, তাহাতেও মুকুট রায়ের গল্প নাই। তবে পীর গোরাচাঁদ দেউলিয়ার চন্দ্রকেতু রাজার ধ্বংসের কারণ তাহা শুনিতে পাওয়া যায়। হিন্দু রাজত্বকালে বালাণ্ডা বাগড়ী বিভাগের একটি প্রধান শাসনকেন্দ্র ছিল। পাঠানেরাও এই স্থানে একজন শাসনকর্তা পাঠাইয়া দক্ষিণ দেশ শাসন করিতেন। প্রাচীন দ্বিগঙ্গার সন্নিকটে দেউলিয়া বলিয়া স্থান ছিল; দেউলিয়া এখনও আছে। এই স্থানে চন্দ্রকেতু নামে রাজা ছিলেন, গোরাই গাজী তাঁহাকে মুসলমান করি-বার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেন, কিন্তু প্রতাপান্বিত যবনদ্বেষী চন্দ্রকেতুকে বশীভূত করিতে পারেন নাই। তখন গোরাইগাজী রাজসরকারে তাঁহার নামে নালিস করেন। এই সময়ে বালাণ্ডায় পীর সাহ নামক একব্যক্তি পাঠান শাসনকর্তা ছিলেন। চন্দ্রকেতুর সর্ব্বনাশ সাধনের ভার পীর সাহের উপর পড়ে। পীর সাহ চন্দ্রকেতুকে আহ্বান করিয়া লইয়া গিয়া তাঁহার উপর নানা অত্যাচার করেন। এখানেও সেই পারাবতের গল্প আছে। পীরসাহ বালাণ্ডায় বন্দী হইলে পারাবত উড়িয়া গিয়া সংবাদ দেয়, তাহাতে পরিবারবর্গ সকলে জলমগ্ন হইয়া প্রাণত্যাগ করেন। চন্দ্রকেতু শেষে উদ্ধার পাইলেও স্বজনহীন জীবন ধারণ করিতে স্বীকৃত না হইয়া আত্মহত্যা করেন। দেউলিয়া শ্মশান হইয়া যায়। এখনও সেখানে কিছু ভগ্নাবশেষ আছে।
এদিকে গোরাই গাজী হাতিয়াগড়ে যান। তথায় রাজা মহিদানন্দের পুত্র অক্ষয়ানন্দ ও বকানন্দ শাসন করিতেন। ইঁহাদের সহিত গোরাচাঁদের বিবাদ ও যুদ্ধ হয়। তাহাতে বকানন্দ নিহত হন এবং গোরাই গাজী ভীষণভাবে আহত হইয়া বালাণ্ডার সন্নিকটবর্তী হাড়োয়ায় আসিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হয়। কালু ঘোষ নামক একজন গোয়ালা তাহার সমাধি কার্য্য সম্পন্ন করে। অবশেষে সেই কথা তদানীন্তন বঙ্গেশ্বর আলাউদ্দীনের (১২৩০-১২৩৭) কর্ণগোচর হইলে তিনি গোরাই গাজীর সমাধির উপর মস্জ্জিদ নির্মাণ করিয়া দেন এবং মসিজদের সেবা নির্ব্বাহ জন্য ১৫০০ বিঘা জমি নিষ্কর দিয়াছিলেন। ১২ই ফাল্গুন তারিখে গোরাই গাজীর মৃত্যু হয়। তদবধি প্রতি বৎসর ঐ তারিখে হাড়োয়ায় এক প্রকাণ্ড মেলা বসে এবং মাসের শেষ পর্যন্ত থাকে। মেলায় ২৫/৩০ হাজার লোক সমবেত হয়। উহাতে চাউলের ক্রয় বিক্রয়ই খুব বেশী হয়। গোরাচাঁদ এক্ষণে হিন্দু মুসলমান উভয়ের আরাধ্য দেবতা। ফকিরেরা এখনও কলিকাতার রাস্তায় বা অন্য স্থানে সন্ধ্যাকালে প্রদীপ জ্বালাইয়া "পীর গোরাচাঁদ মুস্কিল আসান" বলিয়া গান করিয়া ভিক্ষা করিয়া থাকে।
পীর গোরাচাঁদ ব্যতীত আরও কয়েকজন গাজী ফকিরের নাম বিখ্যাত হইয়াছে। বারাসতের একদিল সাহ, বাঁসড়ার মোবারক গাজী, এবং সোণার পুরের সন্নিকটে ঘুটিয়ারি সরিফ। মোবারক বা মোবরা গাজী সুন্দর বনের একাংশের ব্যাঘ্রভীতি নিবারণ করিয়া, সে প্রদেশের সকলের পূজনীয় হইয়াছেন। মোবরা গাজীর দরগা নাই এমন গ্রাম পাওয়া দুষ্কর।। সোণারপুর হইতে ক্যানিং যাইতে ঘুটিয়ারী সরিফ বলিয়া একটি ষ্টেশন আছে। ঐ স্থানে ষ্টেশনের সন্নিকটে সরিফ সাহেবের প্রকাণ্ড দরগাও মজিদ রহিয়াছে। প্রতিবৎসর অম্বুবাচীর দিন সেখানে অসংখ্য লোকের সমাগম হয়। রেলওয়ে কোম্পানীকে স্পেশাল ট্রেণের বন্দোবস্ত করিতে হয়।
মোটের উপর আমরা দেখিলাম, এই গাজীসম্প্রদায় সকলেই হাতিয়াগড় অঞ্চল হইতে আরম্ভ করিয়া ক্রমে যশোহরপুল,নার ভিতর প্রবেশ করিয়া ধৰ্ম্ম প্রচার করিয়াছেন। ইস্লাম ধৰ্ম্মস্রোতের গতি দক্ষিণপশ্চিম কোণ হইতে ক্রমে উত্তরপূর্ব্ব দিকে প্রবাহিত হইয়াছে।