২০১৬ সালের কথা। ক্লাস ফাইভে পড়ি। পড়ালেখায় মন ছিল না তেমন। খেলাধুলা ছিল খুব প্রিয় । সারাদিন খেলাধুলা আর ঘোরাঘুরি করে পার হচ্ছিলো আমার ঐ কৈশোর সময়। ফলশ্রুতিতে যা হওয়ার তাই হলো। রেজাল্ট খারাপ হলো। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরিক্ষায় জিপিএ আসলো ৪.১৭। বাসা থেকে অনেক বকাবকি করলো। পরিবার-পরিজোনের মাঝে ততোদিনে ধারণা তৈরি হওয়া শুরু হলো—এই ছেলের কাছে খুব বেশি প্রত্যাশা রাখা যাবে না। একটা সময়ে আমার মধ্যেও জন্ম নিলো এই বিশ্বাস। আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। হয়তো আমি পারবো না।
তিন বছর পর, ২০১৮ সময় আসলো আরেকটি বড় পরীক্ষা। কিন্তু এবার ভিতরে একটা জেদ তৈরি করলাম। আমাকে পারতেই হবে। ভালো করে পড়াশোনা শুরু করলাম কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে মনে ঐ পুরনো বিশ্বাসটা উঁকি দিতো। ওই যে—আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না! তাই পড়ালেখার মাঝখানে হতাশা কাজ করতো। এই হতাশার কারণেই জেএসসি পরিক্ষায় রেজাল্ট আসলো ৪.৫০। বাসায় আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশীরা ফোন দেয়, আমার আম্মুকে বলে তাদের ছেলেমেয়েরা জিপিএ-৫ পেয়েছে, বাসায় মিষ্টি নিয়ে আসে। আম্মু লজ্জায় বলতে পারেন না আমার রেজাল্ট। আমারও খারাপ লাগে।যখন ক্লাস নাইনে উঠলাম শুরু হলো করোনা। সারা পৃথিবীতে লকডাউন। এই লকডাউনে সারাদিন বসে গেম খেলেছি। করোনার পিরিয়ড শেষ হলেই হঠাৎ করে শুনি চার মাস পর পরীক্ষা কিন্তু আমার তো কিছুই শেষ হয়নি। পড়ালেখার অবস্থা খুব খারাপ, এমনকি বইগুলা যে কোথায় আছে তাও ভুলে গেছি।
আস্তে আস্তে বইগুলো জোগাড় করলাম, পড়াশোনা শুরু করলাম। মনে মনে ঠিক করলাম আগের পরীক্ষাগুলোতে রেজাল্ট খারাপ করেছি অর্থাৎ জিপিএ ফাইভ পাইনি, সকলে ধরেই নিয়েছে আমি কোনদিনও ভালো করতে পারব না। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে গেলে অনেকেই দেখেও না দেখার ভান করতো। যাদের রেজাল্ট এপ্লাস আছে তাদেরকে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় কিন্তু আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে চায় না। মনে মনে অনেক রাগ হলো, জেদ তৈরি করলাম। নিজের কাছে ওয়াদা করলাম—যে কোনো মূল্যে আমাকে ভালো রেজাল্ট করতেই হবে। শুরু করলাম আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে। আমি কখনোই আগে রাত দশটার পরে পড়াশোনা করিনি কিন্তু এইবার পড়াশোনা করা শুরু করলাম গায়ে লাগিয়ে। রাত একটা-দুটো-তিনটে বেজে যেত। যেহেতু অনেক গ্যাপ ছিল তাই আমাকে ১২-১৪ ঘন্টা পর্যন্ত পড়তে হতো। আমার পড়াশোনা দেখে আম্মু প্রথমে ভয় পেল। মাঝে মাঝে বলতো ব্রেনে এত বেশি চাপ দিস না সমস্যা হতে পারে। কিন্তু আমি তো জেদ নিছিলাম ভালো আমাকে করতেই হবে। এইভাবে চার মাস কাটলো সময় আসলো পরীক্ষার। পরীক্ষা দেওয়া শুরু করলাম, ভালোই হচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ গণিত পরীক্ষার রাতে একটু অসুস্থ হলাম এবং পরীক্ষার হলে বমি বমি ভাব হচ্ছিল। ভালোমতো পরীক্ষা দিতে পারলাম না। আমার স্বপ্ন ভেঙে গেলো। ক্লাস এইটের পরীক্ষায় কিছু সাবজেক্টে খারাপ হয় এবং ওই রেজাল্টের সাথে এসএসসির ফল সমন্বয় করা হয়। রেজাল্টের দিন আম্মু নানা স্বপ্ন নিয়ে বসে আছে কিন্তু দেখা গেলো আমার অর্জন ৪.৭২। আমি ভেঙে পড়লাম। আম্মা আমাকে সান্ত্বনা দিলেন, বললেন সামনে ভালো কিছু হবে। কিন্তু অজান্তেই তার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসলো। আমার ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছাটা আরও শক্তিশালী হলো এই ব্যর্থতা থেকে।
প্রিয় পাঠক,
jhikargacha.com-এর ব্লগ বিভাগে আপনিও হতে পারেন একজন লেখক। আপনার জীবনের অভিজ্ঞতা, ভাবনা বা ঝিকরগাছা উপজেলাকে কেন্দ্র করে লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের কাছে। আমরা স্বাগত জানাই গল্প, কবিতা, ভ্রমণকাহিনি, স্মৃতিচারণ, মতামত, কিংবা যেকোনো সৃজনশীল লেখাকে। নির্বাচিত লেখা যথাযথ সম্পাদনার পর প্রকাশ করা হবে আমাদের Blog বিভাগে।
বিস্তারিত জানুন
আমার স্বপ্ন ছিল ঢাকা কলেজে পড়ার। কিন্তু জিপিএ ফাইভ না পাওয়ায় চান্স পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ। তভুও আমি একপ্রকার জেদ নিয়েছিলাম ঢাকাতেই ভর্তি হবো এবং ভালো করে দেখাবো। বাসা থেকে সবাই মানা করলো, শুধু আম্মু আমার পক্ষে ছিল।
এসএসসিতে আমি সাইন্সে ছিলাম কিন্তু চাচ্ছিলাম ইন্টারে কমার্স নিতে। সকলেই মানা করল, তারা যুক্তি দিলো আমি যেন গ্রামের কলেজে সাইন্স নিয়ে পড়ি। কমার্সে গেলে জীবনে কিছুই করতে পারবো না। কিন্তু নিজের কথায় অটল থাকলাম আমি। সবার কথা উপেক্ষা করে কলেজ চয়েজ দিলাম মিরপুরের সরকারি বাংলা কলেজ। বাসা থেকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু আমি কারোর কথা না শুনে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম একা একাই। কেউ আমার সঙ্গে আসলো না। আর সেদিনই আমি গান্ধীজীর উদ্দেশ্যে তৈরি করা গানের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ চরণটির মূল্য বুঝতে পারলাম।
যেদিন আমি একা একা ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি, সেই দিনই আমি জিতে গিয়েছিলাম। আমি নিজের সঙ্গে ওয়াদা করলাম শুধু পড়াশোনা নয়, আমাকে সব দিক থেকে চতুর হতে হবে। যারা বলেছিল আমি কোনো কিছুই পারবো না, তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেব ‘আমি পারবো, আমিও পারবো!’ বিতর্ক ক্লাবে যুক্ত হলাম, থিয়েটারে যুক্ত হলাম, আবৃত্তি শুরু করলাম এবং প্রতিদিন ভালো করে পড়াশোনা করলাম। যখনই এগুলা ভালো লাগতো না, অলসতা লাগতো তখনই চিন্তা করতাম যে তারা তো বলেছে আমি পারবো না, কিন্তু আমাকে পারতেই হবে, তাদেরকে ভুল প্রমাণ করতে হবে।
আমি সৌভাগ্যবান ছিলাম, যে ম্যাসে উঠেছিলাম সেখানে কয়েকজন বড় ভাইকে পেলাম। তাদের থেকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা পেলাম, কীভাবে পড়লে এডমিশনে সেরা করা যাবে, কোন বই পড়া লাগবে ইত্যাদি। সেই অনুযায়ী পড়াশোনা করলাম। খরচ বাঁচানোর জন্য এবং বাসা থেকে সর্বোচ্চ কম টাকা নেওয়ার জন্য অনলাইনে পড়া শুরু করলাম। পুরো ইন্টারে ইউটিউবে ফ্রি ক্লাস করলাম এবং আলহামদুলিল্লাহ জীবনে প্রথমবারের মতো এ প্লাস পেলাম। বাসা থেকে সকলে খুব খুশি হলো। মনে আত্মবিশ্বাস বাড়লো। এডমিশনের সময়ে প্রতিদিন ১৪ ঘন্টা পড়েছি। এমন অনেক রাত গেছে সারারাত পড়েছি এবং ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাতে গেছি।
ফলাফল পেলাম—গুচ্ছভুক্ত পরীক্ষায় সারাদেশে ১৫তম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩তম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩৩তম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০৩তম, রাজশাহীতে ৩৬৭তম। মিডিয়ায় আমার ছবি আসলো। পত্রিকায় নিউজ হলো। সবাই অবাক হয়ে গেল। যারা আমাকে বলেছিল আমি কখনোই ভালো করতে পারব না, তারা জবাব পেয়ে গেল।
লেখক: আহম্মেদ সৌরভ
মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
স্থায়ী ঠিকানা: পারবাজার, ঝিকরগাছা।
স্থায়ী ঠিকানা: পারবাজার, ঝিকরগাছা।