নন্দিনী ফুল: ঝিকরগাছায় জাপানি ফুলচাষে নতুন সম্ভাবনার সূচনা

বেগুনি, গোলাপি ও সাদা রঙের লিসিয়ানথাস ফুলের একগুচ্ছ, যা বাংলাদেশে 'নন্দিনী' নামে পরিচিত; গোলাপের মতো পাপড়ি থাকলেও কাঁটাহীন।
নান্দনিক নন্দিনী ফুল

যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার একটি ছোট গ্রাম, পানিসারা—এই গ্রামেই বিগত কয়েক দশকে গড়ে উঠছে বাংলাদেশের ফুলচাষে সম্ভাবনার এক নতুন অধ্যায়। সম্প্রতি ফুলের রাজ্যে যোগ হয়েছে নতুন এক নাম—নন্দিনী। দেখতে অনেকটা গোলাপের মতো হলেও এতে নেই গোলাপের মতো কাঁটা, আর এর সৌন্দর্য কেবল শীতের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়। বর্ষা, গ্রীষ্ম, এমনকি খরার মধ্যেও প্রাণচঞ্চল থাকে এই জাপানি ফুল।

নন্দিনী ফুলের বৈশিষ্ট্যই একে আলাদা করেছে। সাধারণ গোলাপ ফুল যেখানে মাত্র তিন দিন ফুলদানিতে টিকে থাকে, সেখানে নন্দিনী ফুল তার সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারে প্রায় ১২ দিন পর্যন্ত। এ ছাড়া এর পাপড়ির রং অত্যন্ত উজ্জ্বল ও দীর্ঘস্থায়ী—সাদা, বেগুনি, গোলাপি, হলুদ, নীলসহ আটটির বেশি রঙে ফুটে থাকে এই ফুল। ফলে এই ফুল শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, আন্তর্জাতিক ফুল বাজারেও তার অবস্থান তৈরি করার দারুণ সম্ভাবনা রাখে।

নন্দিনী ফুলের বৈশিষ্ট্য সমূহ:
  • সব ঋতুতেই ফোটে: শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা—সব ঋতুতে সমানভাবে ফোটে।
  • সহনশীলতা বেশি: অতিবৃষ্টি বা খরায় সহজে ক্ষতি হয় না।
  • দীর্ঘস্থায়ী সৌন্দর্য: ১২ দিন পর্যন্ত ফুলদানিতে টিকে থাকে।
  • রঙের বৈচিত্র্য: অন্তত ৮টি রঙে ফোটে এই ফুল।

স্থানীয় চাষিদের হাত ধরে প্রথম উদ্যোগ
এই আশাব্যঞ্জক ফুলের চাষে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন ঝিকরগাছার পানিসারা গ্রামের বাসিন্দা মিন্টু সরদার। মাত্র দুই শতক জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে তিনি এই ফুলের চারা রোপণ করেন। তাঁর বর্ণনায়, প্রায় সাড়ে তিন হাজার চারা রোপণের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল এই উদ্যোগ। যদিও কিছু চারা নষ্ট হয়ে যায়, বাকি আড়াই থেকে তিন হাজার গাছ ফুল দিয়েছে সফলভাবে।

প্রতিটি গাছে সাধারণত একটি করে ডাঁটা (স্টিক) থাকে, আর সেই ডাঁটায় ফুটে ৮ থেকে ১০টি করে কুঁড়ি। চাষের শেষে প্রতিটি স্টিক বাজারে বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দরে। সব মিলিয়ে মিন্টু সরদার আশা করছেন, এই ক্ষুদ্র জমিতেই তিনি প্রায় ৬ লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবেন।
পেছনে রয়েছে উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তির সমন্বয়

এই উদ্যোগ শুধু একজন কৃষকের শ্রমে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর পেছনে কাজ করেছে প্রযুক্তির সহায়তা ও উদ্যোক্তার পরিকল্পনা। ঢাকার জারা ফ্লোরি কালচার লিমিটেড-এর কর্ণধার জহির উদ্দিন মো. বাবর এই প্রকল্পে আর্থিক বিনিয়োগ করেছেন, চারা সরবরাহ করেছেন, এমনকি প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও পরামর্শও দিয়েছেন।

তাঁর ভাষায়, “বাংলাদেশে নন্দিনী ফুল এখনো আমদানিনির্ভর। অথচ এর রং, টেকসই গঠন এবং ফুলদানিতে দীর্ঘস্থায়ী থাকার কারণে বাজারে এর চাহিদা অনেক বেশি। আমরা চাই, এই ফুল দেশের মাটিতেই উৎপাদিত হোক।” এই উদ্দেশ্য থেকেই পানিসারা গ্রামে প্রদর্শনী প্লটের মাধ্যমে প্রথম চাষ শুরু হয়।

 
বিশেষায়িত চারা উৎপাদন প্রক্রিয়া
নন্দিনী ফুলের চাষে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর চারা উৎপাদন। সাধারণ ফুলের মতো বীজ থেকে চারা তৈরি সহজ নয়। এই চারা উৎপাদন করে যাচ্ছে এ আর মালিক সিড, একটি ফুলচারা গবেষণা ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোপান মালিক জানান, তারা প্রথমবার জাপান থেকে বীজ সংগ্রহ করে বাংলাদেশে বিশেষ ল্যাবরেটরিতে, নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার মধ্যে, চারা উৎপাদন করেছেন। বীজ থেকে চারা উৎপাদনে লাগে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ দিন, এবং এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি প্রক্রিয়া।

শুধু তাই নয়, এই চারা উৎপাদনের কাজটি তত্ত্বাবধান করছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম জামাল উদ্দিন। তিনি জানান, এই ফুলের চারা অত্যন্ত টেকসই—দুই-তিন দিন গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলেও চারা মরে না, আবার খরাতেও বেশ সহনশীল। ফলে দেশের আবহাওয়া উপযোগী করে তুলতে এই ফুলের সম্ভাবনা অনেক বেশি।


‘নন্দিনী’ নামের পেছনের গল্প
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, “Lisianthus” নামের এই জাপানি ফুলের নাম ‘নন্দিনী’ কীভাবে হলো? এর পেছনে রয়েছে এক ব্যক্তিগত ও হৃদয়স্পর্শী গল্প।

অধ্যাপক জামাল উদ্দিন একসময় জাপানে গবেষণারত ছিলেন। দেশে ফেরার সময় একজন জাপানি অধ্যাপক তাঁকে Lisianthus ফুলের বীজ উপহার দেন। কিন্তু প্যাকেটের গায়ে লেখা “Yostoma” শব্দটি জামাল স্যারের মনে হয় কঠিন। ইমিগ্রেশনে ঝামেলা হবে ভেবে তিনি অনুরোধ করেন সহজ কোনো নাম লেখার জন্য। ওই অধ্যাপক প্রথমে “Jamal” লিখতে চান, কিন্তু ফুলের নাম একজন পুরুষের নামে হোক—এটা স্যারের ভালো লাগে না। তখনই তিনি প্রস্তাব দেন “Nondini” নাম লেখার, যা হয়ে ওঠে এই ফুলের পরিচয়।

এই নামটিই পরে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই জনপ্রিয় হয়ে যায় এবং স্বীকৃতি পায়। এখন এই নামেই ফুলটি চাষ, বাণিজ্য ও গবেষণায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
 

দেশীয় ফুলচাষে নন্দিনীর ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশে বর্তমানে গোলাপ, গাঁদা, জারবেরা প্রভৃতি ফুলের চাষই বেশি প্রচলিত। কিন্তু নন্দিনীর মতো বহুরঙা, দীর্ঘস্থায়ী এবং চাহিদাসম্পন্ন ফুল দেশের ফুলচাষের ভবিষ্যৎ পালটে দিতে পারে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারে ফুল রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো তুলনামূলক দুর্বল—সেখানে নন্দিনী হতে পারে একটি শক্তিশালী পণ্য।

অধ্যাপক জামাল উদ্দিন মনে করেন, “নন্দিনীর ফুলচাষ এখন শুধু শখের জায়গা নয়, বরং দেশের ফুলভিত্তিক অর্থনীতিকে গতিশীল করার একটি হাতিয়ার হতে পারে।” তাঁর মতে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যক্তিপর্যায়ে ল্যাব তৈরি করে চারা উৎপাদন এবং রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল আয় সম্ভব।

📌 তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, উইকিপিডিয়া ও দ্য ডেইলি স্টার।
নবীনতর পূর্বতন

◉ আরও পড়ূন

ট্যাগ সমূহ

ঝিকরগাছার ইতিহাস, ঝিকরগাছা উপজেলার ইউনিয়ন, ঝিকরগাছা খবর, গদখালি ঝিকরগাছা, ঝিকরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান, ঝিকরগাছা পোস্ট কোড, ঝিকরগাছা এমপি, ঝিকরগাছা আবহাওয়া, ঝিকরগাছা উপজেলা ম্যাপ, ঝিকগাছার ঐতিহ্য, পানিসারা, ঝিকরগাছা পৌরসভা, ঝিকরগাছা দর্শনীয় স্থান, ঝিকরগাছা বাজার।