অমৃতবাজার পত্রিকা ও শিশির কুমার ঘোষ

অমৃতবাজার পত্রিকা

'অমৃত বাজার' পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ২০শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে। ওই পত্রিকায় শিশির কুমার ঘোষ তার সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য সম্পর্কে লিখেছিলেন - “স্বার্থ শূণ্য ইংরাজ বাহাদুরেরা... যাহারা কেবল মাত্র আমাদের হিত ও স্বচ্ছন্দতার নিমিত্ত, রাজ শাসনের ন্যায় অতিক্লেশকর ও কঠিন কার্যে আমাদিগকে হস্থক্ষেপ করিতে দেননা, তাহাদিগের রীতিনীতি, উদ্দেশ্য, স্বার্থ শূন্যতা ও কৌশল যথাসাধ্য বর্ণনা করিয়া তাহাদিগের নিকট যে ঋণ পাশে আবদ্ধ আছি, তাহা পরিশোধের যত্ন করি। 

উনিশ শতকে তৎকালীন বাঙলায় যে প্রগতিশীল আন্দোলনের ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল, শিশির কুমার তার লেখনির মাধ্যমে সেই ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন। সমাজ সংস্কার ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার আন্দোলনের পাশাপাশি সংবাদ পত্রের স্বাধীনতার দাবির জন্য ও অমৃতবাজার পত্রিকার ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে আছে।

উল্লেখ্য যে, তৎকালে সরকারি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভারতীয় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সঙ্কোচনের পক্ষে মত ব্যক্ত করেছিলেন। শিশির কুমার ঘোষ বঙ্কিমের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছিলেন : "Certainly in a free country such remarks from a person of Bankim Babu's position would have brought down upon him universal condemnation, but under the pressure of a foreign government even the truest patriot turns traitor to his country.

শিশির কুমার ঘোষ

অমৃতবাজার পত্রিকায় শুধু সংবাদ পত্রের স্বাধীনতার দাবি উত্থাপিত হয়েছিল না-উত্থাপিত হয়েছিল বাক স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের দাবিও। “অমৃত বাজার পত্রিকা'র প্রতিষ্ঠাতা ও নির্ভীক সম্পাদক শিশির কুমার ঘোষ সম্পর্কে প্রখ্যাত কবি নবীনচন্দ্র সেন তার “আমার জীবন" গ্রন্থে লিখেছেন যে- “শিশির তখন মাতৃভূমির দুঃখের কথা বলিতে বলিতে কাঁদিয়া ফেলিতেন, উচ্ছ্বাসে উন্মত্ত হইতেন। যশোহরে লিখিত আমার খণ্ড কবিতায়ও 'পলাশীর যুদ্ধে' স্বাধীনতার জন্য যে নিঃশ্বাস ও মাতৃভূমির জন্য অশ্রু বিসর্জন আছে, তাহা কথঞ্চিত শিশির কুমারের সংসর্গের ও শিক্ষার ফল। তিনি ও তাহার পত্রিকাই প্রথম এই দেশে স্বদেশভক্তির পথ প্রদর্শক।”

ভারতের স্বাধীনতা ও ভারতের পুঁজিবাদী সমাজের প্রয়োজনীয়তার কথা তৎকালীন সংবাদপত্রে বিশেষ ভাবে যে তুলে ধরা হয়েছিল-এতে কোনো সন্দেহ নেই। সংবাদ পত্রের মাধ্যমে ইংরেজ শাসনের নতুন ঔপনিবেশিক শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে জাগরণ সৃষ্টি করেছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণী, তা ছিল সেই আমলেরই পক্ষে বিশেষ উপযোগী। অনেক ঐতিহাসিক বাঙলার তৎকালীন মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে উদ্ভূত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সম্বন্ধে বলেছেন যে ১৮১৩ থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তীকালীন বছরগুলোতে যে সব কৃষক বিদ্রোহ এবং ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে যে জাতীয় অভ্যুত্থান ঘটেছে, তাতে বুদ্ধিজীবীদের কোন ভূমিকা ছিল না। এই মন্তব্যে যে কতটুকু সততা রয়েছে, তার বিচার করার প্রয়োজন। আমাদের ধারণা, এই দেশের বুদ্ধিজীবীরা ওই সময় কালে একেবারে যে নিশ্চুপ ছিলেন তা বিশ্বাস যোগ্য নয়। কারণ তৎকালে ইংরাজ সরকার বিদ্রোহ ও গণঅসন্তোষ চাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে মুদ্রা যন্ত্রের স্বাধীনতা যে হরণ করেছিল, তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। যার ফলে সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীগণের কোন লেখা বা তাদের বিবরণ মতামত প্রকাশের পক্ষে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মূদ্রা যন্ত্রের স্বাধীনতা হরণের একটি প্রামাণ্য সংবাদ নিম্নে তুলে ধরা হলো : “সিপাহী বিদ্রোহ কালে মূদ্রা যন্ত্রের স্বাধীনতা হরণ (সংবাদ প্রভাকর, ১৫ জুন ১৮৫৮। ২ আষাঢ় ১২৬৫) আমারদিগের বর্তমান গবর্ণর জেনরল বাহাদুর বিগত ইংরাজি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন দিবসাবধি ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন তারিখ পর্যন্ত ভারতবর্ষীয় ছাপাযন্ত্রের স্বাধীনতা বন্ধ করেন, আমরা সেই অবধি যে প্রকার সাবধান এবং বিহিত বিবেচনা সহকারে মানে মানে সম্পাদকীয় কাৰ্য্য নিৰ্ব্বাহ করিযা আসিতেছি, তাহা গুণগ্রাহক পাঠক মহাশয়েরা বিশেষ রূপে অবগত আছেন, এক্ষণে ছাপাখানার স্বাধীনতা পুন: প্রাপ্ত হওয়া গেল ।”৪০ ভারতে বদ্ধসমাজ চিন্তায় যা কিছু আলোড়ন এবং জীবনের নড়াচড়া তার প্রাথমিক সূত্রপাত হয়েছিল এই বাঙলা দেশে। ইংরেজরাই এই বাংলা প্রথম দখল করেছিল, এই বাঙলায় ইংরেজের অনুকরণ করে প্রবর্তিত হয়েছিল ইংরেজি শিক্ষা এবং এই বাঙলা থেকেই শুরু হয়েছিল ইংরেজের বিরুদ্ধে বিপ্লব ও বিদ্রোহ। উনিশ শতকের বাঙলায় বাঙালিদের আন্দোলনের বিষয়টিকে ঘুরোপের রেনেশাসের সঙ্গে অনেকেই তুলনা করেছেন। রোপের রেনেশাঁসের মতো ব্যাপক অর্থে না হলেও উনিশ শতকের বাঙলায় প্রাণের একটা প্রচণ্ড স্পন্দন যে ঘটেছিল, তা অস্বীকার করা যায় না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

ট্যাগ সমূহ

ঝিকরগাছার ইতিহাস, ঝিকরগাছা উপজেলার ইউনিয়ন, ঝিকরগাছা খবর, গদখালি ঝিকরগাছা, ঝিকরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান, ঝিকরগাছা পোস্ট কোড, ঝিকরগাছা এমপি, ঝিকরগাছা আবহাওয়া, ঝিকরগাছা উপজেলা ম্যাপ, ঝিকগাছার ঐতিহ্য, পানিসারা, ঝিকরগাছা পৌরসভা, ঝিকরগাছা দর্শনীয় স্থান, ঝিকরগাছা বাজার।